![]() |
তারিক বিন জিয়াদের স্পেন বিজয় - Tariq bin Ziyad Conquered Spain - Part 2 of 3 |
প্রথম পর্ব লিঙ্কঃ
তারিক বিন জিয়াদের স্পেন বিজয়
২য় পর্ব শুরুঃ
এই বলে বৃদ্ধা প্রস্থান করলেন।
কিন্তু অভিযাত্রী সেনাপতি কিংবা সেনাবাহিনীর উপর এই কথাগুলো সামান্যই প্রতিক্রিয়া
সৃষ্টি করল। কারণ মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা
গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহই জানেন। তবু এই বৃদ্ধা মহিলার বক্তব্য দ্বারা এটাই
প্রমাণিত হলো, গথ শাসনকর্তারা জনগণের কাছে কতই না অপ্রিয়
ছিল। আর এই নতুন অভিযাত্রীদের তারা স্বাগতম জানিয়েছিল কত আন্তরিকতার সঙ্গে।
তারিক স্পেনের রাজধানী লক্ষ্য করে
অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল স্বয়ং রাজার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করবেন। কিন্তু
রাজধানী ছিল বহু দূরে। সেখানে পৌছার আগে তাঁকে বহু বাধা অতিক্রম করতে হলো। তারিক
ছিলেন বয়সে তরুণ। তাঁর বাহিনীও ছিল অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তা দেখে কয়েকজন নেতৃস্থানীয়
ব্যক্তি মুসলিম বাহিনীর চেয়ে বহুগণ বড় সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলেন তারিককে বাধা
দিতে। তারা ভেবেছিলেন, সংখ্যাধিক্যের বলে মুসলিম অভিযাত্রী বাহিনীকে
হটিয়ে দিতে
পারবেন। কিন্তু তারা বড় ভুল
করেছিলেন। তারা শুধু সংখ্যাটাকেই বড় করে দেখেছিলেন। ঈমানের তেজে উদ্দীপ্ত
মুসলমানদের তারা চিনতে পারেন নি। কাজেই অভিযাত্রী মুসলিম বাহিনীর অগ্রগতিরোধ করতে ব্যর্থ
হলেন তারা। অবশেষে তারা সমবেত হলেন একজন ঝানু যোদ্ধার পতাকাতলে। তার নাম
থিওডোমীর। থিওডোমীর ছিলেন স্পেনের
মার্সিয়া/মার্সেই প্রদেশের গর্ভনর। তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা। তিনি এক বিশাল
বাহিনী নিয়ে মুসলিম বাহিনীর সম্মুখীন হলেন। ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী দেখে জয়
সম্বন্ধে তিনি ছিলেন নিশ্চিত। ভেবেছিলেন, নিশ্চিহ্ন করে দেবেন মুসলিম
বাহিনীকে। তিনি মুসলিম বাহিনীর অগ্রগতির কথা রাজাকে জানানোও প্রয়োজন বোধ করলেন না—এতই ছিল
তাঁর আত্মবিশ্বাস। ভেবেছিলেন মুসলিম বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়ে তার কৃতিত্বের সংবাদ
দেবেন রাজাকে। তিনি ভর্তসনা করলেন পূর্বেকার পরাজিত সৈন্যদের। বললেন, তাদের
ভীরুতার জন্য পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। তারা ভীরু বলেই পরাজিত হয়েছে।
স্পেনের মাটিতে এটাই তারিকের প্রথম
উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। স্পেনীয়দের আক্রমণের মুখে তার ক্ষুদ্র বাহিনী পাহাড়ের মত অটল
হয়ে রইল। শীঘ্রই স্পেনীয়রা বুঝতে পারল একেকটি মুসলিম সৈন্য একেকটি সিংহ। তারা
মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, যুদ্ধ করছে সিংহের দলের সঙ্গে। তারিক
তাদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলেন। থিওডোমীর প্রাণ নিয়ে পালালেন—পেছনে রেখে
গেলেন তার হাজার হাজার সৈন্যের লাশ। স্পেনীয় বাহিনী তাদের শিবিরগুলো রেখে পালাল।
তাদের বিরাট রসদ ভাণ্ডার বিজয়ী বাহিনীর করতলগত হলো।
থিওডোমীর পালালেন কিন্তু স্পেনীয়দের
অবস্থা যে সঙ্কটময় হয়ে উঠেছে, তখনও বুঝতে পারেননি। তিনি ভাবলেন,
সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলার অভাব, যুদ্ধ পরিচালনায় ক্রটি,
অপ্রতুল অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি কারণে তাঁর পরাজয় হয়েছে। তিনি
সেনাবাহিনীতে জাগাতে চেষ্টা করলেন ধর্মীয় উন্মাদনা। উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বক্তৃতা
দিলেন। আবার সম্মুখীন হলেন মুসলিম বাহিনীর। মরিয়া হয়ে তার হৃত সম্মান উদ্ধার করতে
চাইলেন। কিন্তু শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলেন। অবশেষে বাধ্য হলেন পরাজয় স্বীকার করে
নিতে। তিনি রাজা রডারিককে লিখলেনঃ ‘মহামহিম রাজা, আমাদের
দেশ যাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের নাম-ধাম কিছুই জানি না। এমনকি আমি বলতে
পারছি না তারা কোত্থেকে এসেছে- তারা কি আকাশ থেকে নেমে এসেছে, না পাতাল কুঁড়ে এসেছে তা জানি না। তাদের সংখ্যা সাত হাজারের বেশি হবে না।
তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ সাধারণ, অস্ত্রশস্ত্র হাল্কা। তাদের
অশ্বের সংখ্যাও খুব কম। কিন্তু তারা এতই সাহসী যে তা চিন্তা করা যায় না। তাদের গতি
ক্ষিপ্ত। তাদের শিবিরে তারা মিষ্টভাষী, কোমল অন্তকরণের লোক।
তাদের সুন্দর ব্যবহার মানুষের অন্তরকে জয় করে। তারা ভদ্র এবং মিষ্ট কিন্তু যুদ্ধের
ময়দানে তারা সিংহের চেয়েও সাহসী, বাঘের চেয়েও হিংস্র। তারা
বিদ্যুতের মতই ক্ষিপ্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা পাহাড়ের মত অটল হয়ে দাঁড়ায়। পাহা ভেদ
করা সম্ভব কিন্তু তাদের ব্যুহ ভেদ করা যায় না। সংক্ষেপে বলতে গেলে তাদের সঙ্গে
যুদ্ধ করা অসম্ভব। তাদের সেনাপতি একজন সুদর্শন তরুণ। আপনি শুনে আশ্চর্য হবেন,
তিনি একজন সাধারণ সৈনিকের মত পোশাক পরিধান করেন এবং একজন সাধারণ
সৈনিকের মতই অস্ত্রসজ্জিত। অথচ সকলেই তাকে সম্মান করে। আমাদের এই পবিত্র দেশ থেকে
এই আক্রমণকারীদের বিতাড়িত করার জন্য আমি তিনটি যুদ্ধ করেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে
কি, আমি পরাজিত হয়েছি- যদিও আমার সৈন্যবাহিনী তাদের চেয়ে
বহুগুণ বেশি ছিল। আমার সৈন্যরা এই বিদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আর সাহস পাচ্ছে
না। তারা ভীত হয়ে পড়েছে। এই আক্রমণকারীদের সমুচিত শাস্তি প্রদান করে আমাদের পবিত্র
ভূমিকে মুক্ত করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।’
থিওডোমীরের বিশেষ দূত এই চিঠি নিয়ে
রাজধানীতে পৌছল। কিন্তু রডারিক তখন রাজধানীতে অনুপস্থিত। তিনি তখন অন্য এক জায়গায়
বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত। সেখানে এই চিঠি যখন পেলেন, তখন ভীত হয়ে পড়লেন
শক্তিমদমত্ত রাজা। তিনি বারবার চিঠিখানা পড়লেন। ঘাবড়ে গেলেন রাজা রডারিক। তার মনের
পর্দায় ভেসে উঠল বিদেশী যোদ্ধাদের ছবি। মাথায় তাদের সাদা পাগড়ি, হাতে তাদের উদ্ধত বর্শা। আরো ভেসে উঠল অসহায় ফ্লোরিণ্ডার ছবি–করজোড়ে
চোখের জলে তার ইজ্জত রক্ষার করুণ মিনতি। ভেসে উঠল আরো এমনি অসংখ্য নিরপরাধ নিরীহ
মানুষের মুখচ্ছবি—যাদের উপর করা হয়েছিল জুলুম। রডারিক ছিলেন
চরিত্রহীন কিন্তু বুদ্ধিমান। বুঝতে তাঁর দেরি হলো না, কাউন্ট
জুলিয়ানের এই কাজ। তিনিই শত্রুবাহিনী ডেকে নিয়ে এসেছেন। মনে হলো জুলিয়ানের সেই
কথা। জুলিয়ান বলেছিলেন, তিনি এমন বাজপাখি পাঠাবেন যাদের কথা
স্পেন চিরকাল মনে রাখবে। তখন বুঝতে পারেননি এই বাজপাখি বলতে জুলিয়ান কি বুঝিয়েছিলেন।
আজ তার অর্থ রডারিকের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বুঝতে পারলেন তিনি—তাঁর দিন ফুরিয়ে এসেছে। যত দ্রুত পারলেন
কর্ডোভায় এলেন তিনি। সকল প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের খবর পাঠালেন, তাঁরা
যেন শীঘ্র নিজ নিজ প্রদেশের সমর্থ পুরুষদের রাজধানীতে প্রেরণ করেন। তাদের সঙ্গে
দেওয়া হয় পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র। শীঘ্রই তাঁর পতাকাতলে সমবেত হলো দু’লাখ
সৈন্যের এক বিশাল অস্ত্রসজ্জিত বাহিনী। তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক রাজপুত্র এবং অনেক
খ্রিস্টান পুরোহিত। পুরোহিতরা ক্রুশ হাতে নিয়ে এসেছেন খ্রিস্টান যোদ্ধাদের
আশীর্বাদ করতে এবং মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করতে।
ইতোমধ্যে তারিক প্রাচীন শহর কার্টেজা
অবরোধ করে দখল করে নিলেন এবং শহরটি সুরক্ষিত করে তুললেন। তারপর অনেক দূর পর্যন্ত
পাঠালেন সন্ধানী দল। রডারিকের প্রস্তুতির কথা শুনে তারিক চিন্তিত হলেন। তিনি
মূসাকে অনুরোধ করলেন আরও সৈন্য পাঠাতে। ফলে আফ্রিকা থেকে আরো পাঁচ হাজার বারবার অশ্বারোহী
সেনা এল তার শক্তি বৃদ্ধি করতে। এই নবাগত অশ্বারোহী বাহিনী ছিল বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী
এবং যুদ্ধের কঠোরতায় অভ্যস্ত। সর্বোপরি তারা ছিল ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ এবং
সেনাপতির একান্ত অনুরক্ত আজ্ঞাবহ।
গুয়াডেলেট নদীর তীরে, সমভূমিতে
সমুদ্রের নিকটে দুই বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হলো। রডারিক নিজে সৈন্য পরিচালনা
করছেন। কাজেই যুদ্ধে জয়-পরাজয় যাই ঘটুক, ফলাফল চূড়ান্ত হয়ে
যাবে। তারিক সিদ্ধান্ত নিলেন, ইসলামের মহান ঐতিহ্য অনুযায়ী
একদল প্রতিনিধি পাঠালেন রডারিকের নিকট শান্তির প্রস্তাব দিয়ে। তারিকের
সেনাবাহিনীতে মুঘিস আল-রূমী নামে একজন গ্রীক মুসলমান ছিলেন। তার প্রজ্ঞা আর সাহসের
খ্যাতি ছিল। তাঁকেই নির্বাচিত করা হলো প্রতিনিধি দলের নেতারূপে। রাজা রডারিক এই সাক্ষাৎকার উপলক্ষে বিশেষ
জাঁকজমকের সঙ্গে সজ্জিত করলেন তার শিবিরকে। উদ্দেশ্য জাঁকজমক, ঐশ্বর্য এবং শক্তির নমুনা দেখিয়ে ভীত, বিস্মিত ও হতবাক
করে দেবেন মুসলমানদের। কিন্তু মুসলমানদের সম্বন্ধে সামান্যই জানা ছিল তাঁর।
মুসলমানরা যে পার্থিব জাকজমক, ধন-দৌলত, শক্তি ও গৌরবের কোন মূল্য দেয় না একথা তার জানা ছিল না। রূমী এবং তাঁর
সঙ্গীগণ পরিধান করে এসেছিলেন সাধারণ আরবীয় পোশাক এবং সঙ্গে ছিল সাধারণ তরবারি।
কিন্তু তাঁদের ব্যবহার কথাবার্তা ছিল আরব যোদ্ধার মতই মর্যাদাবান। তাঁদের
আভিজাত্যপূর্ণ ব্যবহার দেখে রাজা রডারিক আশ্চর্য হয়ে গেলেন। রূমী রডারিককে বললেন, ‘হে স্পেনীয়
নরপতি,
আপনাকে জানাচ্ছি যে, আমরা এসেছি সাগরের ওপারের
এক দেশ থেকে। বেশি দিনের কথা নয়, পৃথিবীর অন্যান্য মানুষের
মত এবং আপনার মত আমরাও নিমজ্জিত ছিলাম পাপ পঙ্কে। লজ্জাজনক কাজ করতাম।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে একজন সর্বশেষ পয়গম্বর নিযুক্ত করে আমাদের
উপর তার অপার করুণা বর্ষণ করেছেন। সেই মহামানব আমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন। অল্প
সময়ের ভেতরে এক অলৌকিক পরিবর্তন এনে দিয়েছেন আমাদের মধ্যে। তিনি তাঁর মহান শিক্ষা
এবং কার্যাবলী দ্বারা বদলে দিয়েছেন জীবন সম্বন্ধে আমাদের পূর্ব দৃষ্টিভঙ্গি,
অধঃপতনের গভীর গহব্বর থেকে তিনি আমাদের তুলে এনেছেন। যে আলোকবর্তিকা
তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাই আমরা বহন করে নিয়ে এসেছি আপনার কাছে। আমরা তাঁর
বাণী বহন করে ফিরছি মরুভূমি, সমভূমি এবং উপত্যকায়। আমরা
আপনার নিকট এসেছি এই আশা নিয়ে যে, আপনাকে ভ্রান্ত পথ থেকে
ফিরিয়ে আনতে পারবো এবং সঠিক পথ দেখাব। আমরা এসেছি আপনাকে আপনার রাজ্য এবং ঐশ্বর্য
থেকে বঞ্চিত করতে নয়, বরং আপনাকে দিতে এসেছি ইসলামের
বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব। আপনি দ্বিগুণ উপকৃত হবেন যদি আমাদের ধর্ম এবং জীবন পদ্ধতি
গ্রহণ করেন। অন্যথায় আপনাকে সুযোগ দিচ্ছি আমাদের আশ্রয় গ্রহণ করতে। তাহলে আমরা হবো
আপনার জীবন এবং সম্পত্তির জিম্মাদার। আপনাকে দেব আমরা আপনার ধর্মকর্মের স্বাধীনতা।
যদি আপনি আমাদের প্রস্তাব দুটো গ্রহণ না করেন, তবে তরবারি
দ্বারাই আমাদের বিরোধের মীমাংসা হবে।’
রডারিক মুগ্ধ হলেন রূমীর সরল কিন্তু
সাহসিকতাপূর্ণ বক্তব্য শুনে। তিনি আশ্চর্যান্বিত হলেন রূমীর বাগ্মিতায়। তিনি
ভেবেছিলেন, তারা এক অসভ্য জাতি। এখন তিনি মনে মনে প্রশংসা না করে
পারলেন না মুসলমানদের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সভ্যতার। কিন্তু
অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল তার মিথ্যা অহংবোধ। রডারিক বললেন, ‘আমরা আপনার
সন্ধির শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করছি। আমি আপনাদের প্রাণে মারবো না যদি আপনারা
আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যান। যে সমস্ত মালামাল আপনারা হস্তগত করেছেন আমাদের শুভেচ্ছার
প্রতীক হিসেবে তা দ্বিধাহীন চিত্তে আমরা আপনাদের দান করছি। আর ক্ষমা করছি, যে
রক্তপাত আপনারা ঘটিয়েছেন সেই অপরাধ।’
রূমী বললেন, ‘আপনি
আমাদের যা দিতে চাচ্ছেন সে জন্য আমাদের মহান সেনাপতির পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ
দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের দাবি পুনরায় উত্থাপন করছি। আপনাকে আমরা আবার জানাচ্ছি, আমাদের
দেশ থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি—এক বিরাট
উদ্দেশ্যে। আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কখনও ফিরে যাব না। আমাদের
উদ্দেশ্য আপনার নিকট ব্যক্ত করা হয়েছে। আমাদের পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদের
হটিয়ে দিই। আমরা আপনার যুদ্ধের প্রস্তাব গ্রহণ করছি এবং আমাদের সাফল্যের জন্য
প্রার্থনা করছি।’
রূমীর জোরালো কথা রডারিকের অন্তরে
তীরের মত বিদ্ধ হলো। তিনি দেখতে পেলেন মৃত্যুর বিভীষিকা। বুঝতে পারলেন, চরম
মুহূর্ত সমাগতপ্রায়। তা থেকে পলায়নের কোন উপায় নেই। সারারাত বিছানায় ছটফট করে
কাটালেন রাজা রডারিক।
পরদিন। ধূসর প্রাতঃকাল। তিনি
সৈন্যবাহিনীকে সামরিক কায়দায় সাজালেন। মণিমুক্তা খচিত একটি মস্তবড় চাঁদোয়ার নীচে
হস্তীদন্ত নির্মিত একটি রথে আরোহণ করলেন তিনি। তাঁর চতুর্দিক ঘিরে রাখল মাথা থেকে
পা পর্যন্ত ইস্পাতের বর্মে আচ্ছাদিত তাঁর ত্রিশ হাজার দেহরক্ষী সৈন্য। তাঁর
পার্শ্বে ও পিছনে অপেক্ষমান ছিল অশ্বারোহী সেনা। ঘোড়সওয়ার সেনাদের মাথায় ছিল
ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ। তারা ছিল ঢাল, ধনুক, বর্শা এবং ভারী তলোয়ার দ্বারা সুসজ্জিত। তারিক সারারাত কাটালেন দোয়া করে।
ফজরের নামাযে করলেন ইমামতি। তারপর সৈন্যদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার কোন পথ নেই।
সম্মুখে শত্রু, পেছনে আছে নদী। একমাত্র আল্লাহর উপর ঈমান এবং
তাঁর পুরস্কার পাবে এই বিশ্বাসেই আছে তোমাদের নিরাপত্তা। এই গুণাবলীর যদি অধিকারী
হও, তবে তোমরা হবে অজেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্যই বড় কথা
নয়—আসল কথা হচ্ছে ঈমান, যা নিয়ে যুদ্ধ করছ। আমাকে
অনুসরণ করবে, যদি আমি আক্রমণ করি তোমরাও আক্রমণ করবে। যদি
আমি থেমে যাই, তোমরাও থামবে। আমি সেই অহংকারী অবিশ্বাসীর
সঙ্গে যুদ্ধ করবো। যদি আমি মৃত্যুবরণ করি, তবে আমার মৃত্যুতে
তোমরা দুঃখ করো না শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেয়ো। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ো না।
পুরুষের মতো যুদ্ধ করে যেয়ো। তোমাদের নিজকে এবং তোমাদের জাতিকে অপমানিত করো না। যদি
কাপুরুষের পরিচয় দাও, তবে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে যাবে
তোমাদের নাম আর যদি সাহসের পরিচয় দিতে পার, তবে পাবে এই
সমৃদ্ধ এবং ঐশ্বর্যশালিনী দেশের শাসন ক্ষমতা। মনে রেখো, যদি
তোমরা জয়লাভ করো তবে তোমরা হবে গাযী আর যদি মত্যুবরণ করো তবে হবে শহীদ। আল্লাহ এবং
তাঁর নবী তোমাদের দেখছেন এবং তোমাদের সঙ্গে আছেন কারণ তোমরা যুদ্ধ করছো তাঁদের জন্যই।’
মুসলিম বাহিনীতে সাড়া এলো কর্ণ
বিদারী আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে। তারা ঊর্ধ্বে উত্তোলন করল তাদের তরবারি আশ্বাস দিল
তারা তাদের তরুণ সেনাপতিকে, তারা জয়লাভ করবেই হয় তারা হবে গাযী, নয় হবে শহীদ। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত যুদ্ধ হলো। সকল চরাচর যেন উন্মুখ হয়ে
দেখছে, এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফলের উপর নির্ভর
করছে আগামী বহু শতাব্দীর স্পেনের ইতিহাস—যে ইতিহাস শান্তির, সমৃদ্ধির,
ন্যায় বিচারের এবং সাম্যের—যে ইতিহাস একটা
দেশের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার ইতিহাস। আজ যুদ্ধ হচ্ছে আলোর সঙ্গে আঁধারের, ন্যায়ের
সঙ্গে অন্যায়ের, মঙ্গলের সঙ্গে অমঙ্গলের।
গুয়ালেট নদীর তীরে দুই বাহিনী
সম্মুখীন। খ্রিস্টান বাহিনীতে ছিলেন শত শত পুরোহিত। তারা লম্বা পোশাক পরে হাতে
ক্রুশ নিয়ে স্পেনীয় খ্রিস্টান বাহিনীকে উৎসাহিত করছিলেন। আর মুসলিম বাহিনী জানে, হয়
জয়, নয় মৃত্যু। হয় গাযী, নয় শহীদ।
মুসলিম সৈন্যগণ এমন সাহস ও শৌর্যবীর্যের সঙ্গে লড়াই করলো যে, খ্রিস্টান বাহিনীর মধ্যে দেখা দিল হতাশা ও ভীতি। রাজা রডারিক দেখলেন যে,
কমে আসছে তার সৈন্য বাহিনীর মনোবল। আদেশ করলেন তিনি সারাদেহ
ইস্পাতের বর্মদ্বারা আবৃত তার ত্রিশ হাজার দেহরক্ষী সৈন্যকে মুসলিম বাহিনীর
কেন্দ্রভাগে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে। তারা যখন অগ্রসর হলো মনে হলো যেন ইস্পাতের
একটি বিশাল দেয়াল মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে আসছে।
তারিকও প্রস্তুত হলেন এই ইস্পাতের
দেয়ালকে প্রতিহত করতে। তিনি আদেশ দিলেন বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুসলিম
তীরন্দাজদের—ইস্পাতের বর্মাবৃত অগ্রসরমান শত্রুপক্ষীয় অশ্বারোহী সেনাদের
চোখ নিশানা করে তীর ছুঁড়তে। কারণ শত্রু সৈন্যদের চোখই শুধু খোলা ছিল—আর সারা
শরীরই ছিল ইস্পাতের বর্ম দ্বারা আবৃত । আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে মুসলিম বাহিনী
শুরু করল জীবনপণ সংগ্রাম। সুদক্ষ মুসলিম বাহিনীর তীরন্দাজগণ শত্রুসৈন্যের চোখ
লক্ষ্য করে ছুঁড়তে লাগল ভয়ঙ্কর সব তীর। অল্পক্ষণের মধ্যেই শত্রুসেনাদের মাঝে শুরু
হলো এক ভয়াবহ বিপর্যয়। হাজার হাজার অশ্বারোহী সৈন্য হারাল তাদের দৃষ্টিশক্তি—চিরকালের
জন্য কিন্তু তাদের সংখ্যা যে অনেক। তারা এগিয়ে আসছে তো আসছেই। এবারে কাজের ভার পড়ল
তলোয়ারধারী মুসলিম সৈন্যদের ওপর। তাদের তরবারির আঘাতে আঘাতে খ্রিস্টান সৈন্যরা তখন
কচুকাটা হচ্ছে। ভয়ে কাঁপছে খ্রিস্টান বাহিনী। তবু রডারিক ভয়ে কম্পমান সৈন্যদের
ঠেলে শুধু সম্মুখে পাঠাচ্ছেন মুসলিম বাহিনীকে হটিয়ে দিতে। কিন্তু খ্রিস্টান বাহিনী
মুসলিম সেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে তাদের মৃত সঙ্গীদের মতই নিজেদের অসহায় মনে
করল। সিংহহৃদয় মুসলিম সেনাদের সঙ্গে কিছুতেই তারা সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। দিন
শেষে দেখা গেল খ্রিস্টানদের ত্রিশ হাজার বর্মাবৃত অশ্বারোহী বাহিনী প্রায় ধ্বংস হয়ে
গেছে। খ্রিস্টান বাহিনীর মেরুদণ্ডই ভেঙ্গে গেল অথচ তাদের নিয়ে রাজা রডারিকের কতই
না গর্ব ছিল।
গুয়ালেট নদীর তীরে নেমে এল সন্ধ্যার
অন্ধকার। স্পেনীয় বাহিনীই রণক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তনের শিঙ্গা বাজাল। সত্য বটে, তাদের
শ্রেষ্ঠ অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু তাদের সংখ্যা এত অধিক যে কয়েক সপ্তাহ লেগে
যাবে তাদের ধ্বংস করতে। ক্লান্ত দেহে দুরু দুরু বক্ষে বিপর্যস্ত রাজা রডারিক ফিরে
এলেন তাঁর শিবিরে। পরদিন জয়লাভের নতুন সঙ্কল্প নিয়ে তার সেনাবাহিনীসহ আবার
যুদ্ধক্ষেত্রে আবির্ভূত হলেন। পূর্বদিনের মতই তিনি দেখলেন মুসলমানদের তরবারির মুখে
তার সৈন্যদের অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ। তবু দলের পর দল সৈন্য পাঠালেন সম্মুখে, এ যেন জ্বলন্ত চুল্লীর মুখে জ্বালানি ঠেলে দেয়া। মুসলিম বাহিনী স্পেনীয়
সৈন্যদের হত্যা করে চলল। আবার নেমে এল সন্ধ্যা।
দিন শেষে গথিক রাজাকে দেখা গেল
বিমর্ষ হতাশাগ্রস্ত। ফিরে গেলেন তিনি নিজের তাবুতে। তাকে অনুসরণ করল তার ভগ্নমনোবল
সেনাবাহিনী। গত দেড় দিনের যুদ্ধে তাদের সৈন্যবলের এক-চতুর্থাংশ শেষ হয়ে গেছে। এই
ভয়াবহ যুদ্ধ গড়িয়ে চলল এক সপ্তাহ ধরে। তবু শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। উভয় বাহিনীতে
দেখা দিল অস্থিরতা এবং অধৈর্যের লক্ষণ। রাজা রডারিক তাঁর রথে চড়ে দেখলেন মুসলিম
বাহিনীর রণকৌশল। তিনি আরও দেখলেন, তার হঠকারিতার ফলে কিভাবে তার সৈন্যরা
বিপুল সংখ্যায় হতাহত হলো— আর সে তুলনায় মুসলিম বাহিনীর
ক্ষতি সামান্যই। তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে তিনি পাল্টে দিলেন তার যুদ্ধ-কৌশল।
তারিকও উদ্বিগ্ন ছিলেন চূড়ান্ত জয়লাভ
করতে। যদিও তার ক্ষতি হয়েছিল সামান্যই —তবুও তা ছিল তাঁর
ক্ষুদ্র বাহিনীর পক্ষে অনেক। কারণ তার বাহিনী স্পেনীয় বাহিনীর তুলনায় অতি ক্ষুদ্র।
তাছাড়া আফ্রিকা থেকে আর সৈন্য সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না অথচ
শত্রুবাহিনী যুদ্ধ করছে নিজের দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তার সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছে
পুরোপুরি। পক্ষান্তরে মুসলিম বাহিনীর কোন দিক থেকে সাহায্য পাওয়ার উপায় ছিল না।
যুদ্ধের অষ্টম দিন এসে গেল। রডারিক
তাঁর শ্বেত অশ্ব আরিলিয়ার পিঠে আরোহণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন।
তিনি এক নতুন যুদ্ধ কৌশল স্থির করে এসেছেন।
তাঁর সেনাদলকে আদেশ করলেন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ করতে। কৌশলটি হলো এই—একটি দল মুসলিম
বাহিনীকে আক্রমণ করবে। তারপর তারা ফিরে আসবে, আবার আরেকটি দল এসে আক্রমণ
করবে। এভাবে স্পেনীয়দের আক্রমণ চলতে থাকবে। পক্ষান্তরে মুসলিম বাহিনী ক্ষুদ্র
হওয়ায় তাদের সারাক্ষণ যুদ্ধ করতে হবে। এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলিম
বাহিনীকে ক্লান্ত করে ফেলা—তারপর চরম আঘাত করে
তাদের ছিন্নভিন্ন করে দেয়া।।
রডারিককে অশ্বপৃষ্ঠে দেখে তারিক
আনন্দিত হলেন। কারণ এবার তাঁকে নাগালে পাবেন। তারিক ভাল করেই জানতেন, স্পেনীয়রা
যে এখনও কিছুটা মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করছে তা শুধু রডারিকের উপস্থিতির জন্যই। রডারিককে
কাবু করতে পারলেই স্পেনীয়দের যুদ্ধস্পৃহা আর থাকবে না।
পরিকল্পনা অনুযায়ী স্পেনীয়দের
সৈন্যদল ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মুসলিম বাহিনীর সারিতে আক্রমণ করতে লাগল।
পরিকল্পনা মুতাবিক স্পেনীয় বাহিনীর একেক দল কতক্ষণ যুদ্ধ করে ফিরে যেত, আবার
আরেক দল এসে হাযির হতো। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর টিকে থাকার মূলে ছিল
সংহতি, সাহস ও মহত লক্ষ্য। সর্বোপরি আল্লাহর উপর দ্বিধাহীন
বিশ্বাস। তারা জয়লাভ করতেই এসেছে— জয়লাভ তারা করবেই।
অন্যদিকে খ্রিস্টান বাহিনী যুদ্ধ করতে
এসেছে রাজা তাদের আদেশ করেছেন বলে। তারা যুদ্ধ করছে তাদের অত্যাচারী রাজা তাদের
যুদ্ধ করতে পাঠাচ্ছেন বলে। তারা জানতো তারা যুদ্ধ করছে কোন মহত আদর্শের জন্য নয়, বরং
তাদের অত্যাচারী শাসককে রক্ষা করার জন্য—তাঁর রাজ্যকে
রক্ষার জন্য। তারা এও জানত যে, রাজা রক্ষা পেলে তাদের নিজেদের দুর্দশা
আরও বেড়ে যাবে। তারিক তীক্ষ দৃষ্টি রাখছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের উপর। যেখানেই দেখতেন
তার সৈন্যরা বিপদে পড়েছে সেখানেই উপস্থিত হতেন। এজন্য এক হাজার বাছা বাছা ঘোড়সওয়ার
নিয়ে একটি দল তৈরি করেছিলেন, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময় তাঁর
সঙ্গে সঙ্গে ফিরত। যেখানেই সঙ্কট দেখা দিত সেখানে তারা তারিকের সঙ্গে সিংহের মত
ঝাপিয়ে পড়ত। এক সময়ে তারিক পেয়ে গেলেন রডারিকের কাছে যাওয়ার বহু প্রতীক্ষিত এক সুযোগ।
কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে তারিক তাঁকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহবান জানালেন।
রডারিক যখন দেখলেন এক অল্প বয়স্ক
তরুণ মুসলিম যোদ্ধা তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহবান করছে, তখন
বিদ্রুপের হাসি হাসলেন এবং বললেন কি করে সেই অল্প বয়স্ক তরুণ রডারিকের মত একজন
ঝানু যোদ্ধাকে যুদ্ধে আহবান করতে সাহস পাচ্ছে, যার তরবারি
তরুণ যোদ্ধার দেহের চেয়েও দীর্ঘ। তারিক উত্তর দিলেন, শুধু
দীর্ঘ তরবারি হলেই যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। রাগে অস্থির হয়ে এগিয়ে এলেন রডারিক।
আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলেন তারিককে কিন্তু তারিক দক্ষতার সঙ্গে সেই সব আঘাত
ফিরিয়ে দিলেন। শীঘ্রই রডারিক বুঝতে পারলেন তিনি কার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন—সেই তরুণ
যোদ্ধা মুসলিম সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক তারিক ছাড়া আর কেউ নয়।
উভয় সৈন্যদল কিছুটা পেছনে হটে
অবস্থান নিল এবং দেখতে লাগল দুই পক্ষের অধিনায়কের জীবন-মরণ যুদ্ধ। তারিক সুযোগের
সন্ধান করছিলেন। কিন্তু সম্মুখ দিক থেকে রডারিককে আক্রমণ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
রডারিকের দীর্ঘ তলোয়ারটি ছিল বড় বাধা। কাজেই তারিক পরিকল্পনা করলেন তার পেছন দিক
থেকে আক্রমণ করতে। তাই তিনি তাঁর ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে নিলেন। অপর দিকে রডারিকের
স্পেনীয় ঘোড়া থাকায় ঘোড়াটি আরও ওজনে ভারী। আর তার আরোহী রডারিক ইস্পাতের বর্ম
দ্বারা আচ্ছাদিত ভারী হয়ে উঠেছিল। তারিকের বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন আরবী ঘোড়ার
সঙ্গে ভারী স্পেনীয় ঘোড়া আরো ভারী আরোহী নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুরতে পারল না। কাজেই তারিক
পেয়ে গেলেন মোক্ষম সুযোগ। ঘোড়া নিয়ে রডারিকের পেছনে গিয়ে তাঁর মাথায় হানলেন প্রচণ্ড
আঘাত। রডারিক গুরুতরভাবে আহত হলেন—জ্ঞান হারিয়ে
অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন।
রডারিকের সওয়ারবিহীন অশ্ব দেখে
স্পেনীয় সেনাদের মধ্যে দেখা দিল ভয়। তারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে শুরু করল। মুসলিম
বাহিনী এই সুবর্ণ সুযোগটির জন্যই অপেক্ষা করছিল দীর্ঘ সাত দিন ধরে। তাদের আল্লাহু
আকবর রবে কেঁপে উঠল গুয়ালেট নদীর তীর, রণপ্রান্তর, দিক-দিগন্ত।
ক্ষুধার্ত শার্দুলের মত ঝাপিয়ে পড়ল
তারা পলায়নপর স্পেনীয়দের উপর। স্পেনীশ সৈন্যরা ঝড়ের মুখে তৃণের মত ছত্রভঙ্গ হয়ে
চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। আত্মরক্ষার জন্য হাজার হাজার স্পেনীয় সৈন্য ঝাঁপ দিল
গুয়াডালেট নদীতে—সেখানে ডুবে মরল অনেকেই। আর অসংখ্য নিহত হলো
পলায়নের সময় আর রডারিকের কি হলো?
এ সম্বন্ধে সঠিক কেউ বলতে পারে না।
মনে হয় তিনিও নদীতে ডুবে মরেছেন। মুসলমানদের জয় হলো চূড়ান্ত। আটদিনের মধ্যে তারিক
এমন একটি রাজ্য ধ্বংস করে দিলেন যা গড়ে উঠেছিল বহু শতাব্দী ধরে, বহু
লোকের সাধনায় এবং রক্তপাতে। এর ধ্বংসস্তুপের উপর যে মুসলিম রাজ্য গড়ে উঠেছিল তাও
স্থায়ী হয়েছিল বহু শতাব্দীব্যাপী। মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে বহু মালমাত্তা
পেল। এত দ্রব্য-সামগ্রী পাওয়া গেল যে, মনে হলো যেন বিলাসী
রডারিক তার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন একটি শহর। এত ঘোড়া পাওয়া গেল যে, সমগ্র মুসলিম বাহিনীই সওয়ার হতে পারে। আর বন্দীদের সংখ্যা মুসলিম সেনাদের
দ্বিগুণ হয়ে গেল।
তারিক কয়েকদিন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান
করলেন। দাফন করলেন শহীদদের লাশ এবং ঠিক করে নিলেন ভবিষ্যত পরিকল্পনা। আর অবিলম্বে
দূত পাঠিয়ে দিলেন কায়রোয়ানে বৃদ্ধ সেনাপতি মূসার কাছে, যিনি
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন স্পেন বিজয়ের সংবাদ শুনতে। সঙ্গে পাঠালেন
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাপ্ত বিপুল দ্রব্য সম্ভার। এই মহাবিজয়ের সংবাদ শুনে কায়রোয়ান হলো
উৎসবমুখর। সেদিন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন যে লোকটি তিনি সেনাপতি, মূসা। তার এতদিনের স্বপ্ন, এতদিনের সাধনা আজ সফল
হয়েছে। তার প্রিয় শিষ্য মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে জয় করেছে এক বিশাল রাজ্য ইউরোপের
বুকে সর্বপ্রথম প্রোথিত করেছে ইসলামী ঝাণ্ডা। আল্লাহ-তা’আলার অপার
কৃপায় মুসলমানগণ লাভ করল এক বিরাট বিজয় এবং এক সুসমৃদ্ধ দেশ। তারিকের সেনাবাহিনী
তাদের সমস্ত অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে শোকরিয়া জানাল সর্বশক্তিমান আল্লাহর
উদ্দেশ্যে। তাদের শোকরিয়া নামায এতই হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল যে, অবিশ্বাসীরাও
মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকেই ইসলাম কবুল করল।
গুয়ালেটের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে
রডারিকের যে সমস্ত সৈন্য পালাতে পেরেছিল তারা সমবেত হচ্ছিল দেশের অভ্যন্তরে। তা ছাড়াও
দেশের অভ্যন্তরে ছিল বিভিন্ন শাসনকর্তা এবং সম্রান্ত ব্যক্তি। তারিক বুঝেছিলেন
বিশ্রাম নেবার সময় তখনও তাঁর আসেনি। শত্রুদের সময় দেয়া যাবে না। ওরা সময় পেলেই
শক্তি সঞ্চয় করে রুখে দাঁড়াবে। কাজেই অবিলম্বে তাদের আঘাত হানতে হবে—তাদের
ধ্বংস করে দিতে হবে। তাঁর পরবর্তী লক্ষ্যস্থান ছিল ইসিজা। এখানে সমবেত হয়েছিল গুয়ালেট
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলাতক সৈন্যরা। ইসিজা দখল করে রাজধানী টলেডোর দিকে অগ্রসর হতে চাইলেন
তারিক।
পরের পর্ব
পরের পর্ব
No comments:
Post a Comment