![]() |
রম্য গল্প - হোসনী শাহ যখন রেগে যায় - জি. ডি. খোসলা - Bangla Funny Story - Hoshni Shah zokhon rege zay |
অনুবাদ ও রম্য গল্প - হোসনী শাহ যখন
রেগে যায় - জি ডি
খোসলা
হোসনী শাহ
শহরের অন্যতম ধনাঢ্য বস্ত্র ব্যবসায়ীই শুধু নয়, সর্বদা
হাসিখুশি একজন মানুষও বটে। তার সঙ্গে স্রেফ গল্প করে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া
যায়। বিরাট দোকানের চারপাশে সুতি, সিল্ক আর উলের
স্তুপের মাঝখানে পা মুড়ে বসে হোসনী শাহর গোল আলু মার্কা গোলাপি মুখখানা বেঁচে
থাকার আনন্দে জ্বলজ্বল করে। সে একসঙ্গে দশজন খদ্দের সামলানোর ক্ষমতা রাখে, সহকারীদেরকে জোর গলায় জানিয়ে দেয় খদ্দের কী ধরনের কাপড় দেখতে চাইছে।
কর্মচারীরা নির্দেশ মাফিক স্যাটিন, জর্জেট, শিফন, সার্জ, মসলিন, ফ্ল্যানেল, ছিট কিংবা টুকরো কাপড় ছুঁড়ে দেয়। দক্ষতার
সাথে ওগুলো হাতে লুফে নেয় হোসনী শাহ, বছরের পর বছর
অনুশীলনকারী কুশলী হাতে খদ্দেরের সামনে ওগুলো মেলে ধরে।
আপনি যা চাইছেন
ঠিক সে জিনিসটি আপনার সামনে হাজির করবে হোসনী শাহ। তিন হাজার রকম কাপড়ের সম্ভারের
প্রতিটির দাম তার জানা। আমার অবাক লাগে ভেবে যে, সে এত নিখুঁতভাবে কাজ করে কীভাবে। কাপড় বিক্রির হিসাবটা রাখে তার পিছনে
বসা এক হিসাবরক্ষক। হাঁটুর উপর রাখা লম্বা খেরোখাতায় মনিবের হিসাবের বর্ণনা দ্রুত ও
সংক্ষিপ্তভাবে লিখে রাখে সে।
‘ছয় গজ সাংহাই, এক রূপী আট আনা; স্যাটিন ছাপা গজ,
প্রতি গজ সাড়ে তিন রূপী; লতা ছবি মার্কা,
এক পিস, চল্লিশ রূপী, মসলিন
ছাব্বিশ, এক পিস, দশ রূপী।’
মাঝে মাঝে
দোকানে ভিড় এমন বেড়ে যায় আর হোসনী শাই তার খদ্দেরকে এমন দ্রুততার সঙ্গে কাপড়
বিক্রি করে যে হিসাবরক্ষক হিসাব লিখে রাখতে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যায়। কিন্তু হোসনী
শাহ্ মুখে দিব্যি সুখী মানুষের হাসি ধরে রেখে কাজ করে যাচ্ছে। আর এ হাসি
সার্বক্ষণিক ধরে রাখে সে। তার ব্যবসা করার প্রক্রিয়া দেখেও শেখার অনেক কিছু আছে।
হোসনী শাহকে
শহরের সবাই সম্মান করে, ভালবাসে। কাপড়ের ব্যবসা
করে প্রচুর আয় করলেও সে কিন্তু অত্যন্ত সৎ। কখনও জোচ্চুরি করে না। হৃষ্টপুষ্ট
গড়নের হোসনী শাহ্ সাদা শার্ট পরে দোকানে আসে। মাথায় গোল টুপি, মোটাসোটা হাসিখুশি মুখখানা। সে যখন ভুড়ি বাগিয়ে হেলেদুলে রাস্তা দিয়ে
হাঁটে, যার সঙ্গেই দেখা হয়, তাকে
সম্বোধন করে ‘শাহি মহারাজ’ কিংবা ‘সালাম, শাহজি’ বলে। হাসিমুখে সম্বোধন ফিরিয়ে দেয় হোসনী, ঘনিষ্ঠ
দু’একজনের সঙ্গে ঠাট্টা
মশকরাও করে। কেউ কেউ ঈর্ষা করে হোসনী শাহকে। বলে পঞ্চাশ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়েই হোসনী
শাহকে এমন হাসিখুশি রেখেছে। প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর দশ বছর আগে এক তরুণীকে বিয়ে
করেছে সে। তার প্রথম স্ত্রী ছিল স্বামী আর সংসার অন্তপ্রাণ। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে
হঠাৎ করেই দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা মাথায় আসে হোসনী শাহ’র। সে লোহার ব্যবসায়ী আব্দুর রহীমের সুন্দরী মেয়েকে
বিয়ে করার পরেই নাকি যৌবন ফিরে পায়।
‘জানেন না,’ ঈর্ষাকাতর লোকগুলো
মাথা দুলিয়ে বলে, ‘বুড়ো বয়সে যৌবন ফিরে পেতে তরুণীদের সাহচর্যের তুলনা
নেই?’
তবে অন্যেরা (এদের
মধ্যে বেশিরভাগ স্থানীয় বাসিন্দা) হোসনী শাহ’র প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল। তারা হোসনী শাহকে কুড়ি
বছর ধরে চেনে। আগে তার নাম ছিল হোসেন শাহ ব্যবসা করে লাল হয়ে ওঠার বহু আগে থেকেই
সে এরকম হাসিখুশি স্বভাবের। লোকে বলে হোসনী সুখী কারণ নীতিবোধের প্রশ্নে সে অটল।
সে জানে সে কখনও অন্যায় করে না, মানুষ ঠকায় না। সব
কাজ সে করে আল্লাহর নামে। আর আল্লাহও তার প্রতি খুব সদয়।’
বছর আটেক আগে হোসনী
শাহ’র সঙ্গে আমার পরিচয়!
তখনই বুঝতে পারি সে কত হৃদয়বান এবং বড় মাপের মানুষ। সে আমার কাছে এক পাইকারি
বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য এসেছিল। দাম পড়ে যাওয়ায় লোকটা বড় ধরনের একটা
চালান নিতে অস্বীকার করছিল। হোসনী শাহ ক্ষতিপূরণের দাবি করছিল কিন্তু ডিলার তা
দেবে না। আমি অবশ্য হোসনী শাহকে বলেছিলাম সে ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবে।
‘ব্যারিস্টার সাহেব,’ বলেছিল হোসনী, ‘আমি ওদেরকে দেখিয়ে দিতে চাই, হোসনী শাহকে কেউ বোকা বানাতে পারবে না। আমার পাওনা আমি আদায়
করবই, ইনশা আল্লাহ।’
সরকারের হুকুমে
হোসনী শাহর দাবি পূরণ করা হয় এবং পাইকারি ডিলারের ফার্ম পুরো টাকা দিতে বাধ্য হয়।
তারপর থেকে হোসনী শাহ’র সঙ্গে পেশাদারী কাজে নানা সময় দেখা হয়েছে আমার। আমরা ক্রমে বন্ধু হয়ে যাই। ব্যবসায়
কঠোর নীতিপরায়ণ, সোজাসাপ্টা লোকটি প্রায়ই ঝামেলায়
পড়ে। যেতে হয় আদালতে। তখন ছুটে আসে আমার কাছে। ঘামে ভেজা মুখ মুছতে মুছতে বসে পড়ে টেবিলের
সামনে ক্লায়েন্টদের জন্য রাখা উঁচু হাতলহীন চেয়ারে। তারপর হাসিমুখে, সংক্ষেপে এবং পরিষ্কারভাবে তার কেস নিয়ে কথা বলে। তবে প্রতিপক্ষের প্রতি
কখনও বিষোদগার করতে দেখিনি তাকে।
‘আমি কেন ওদের মন্দ চাইব?’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে সে। ‘আল্লাহই ওদের শাস্তি
দেবেন। কর্মফল ওরা এই জীবনে নতুবা মৃত্যুর পরের জীবনে ভোগ করবে।’
মানে মাঝে দু’একটা পার্টি কিংবা সাক্ষীর উপর ধৈর্য হারিয়ে রেগে
যেতাম। আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করত হোসনী শাহ। ‘সাহেবজী, আপনি
রেগে যাচ্ছেন কেন? ক্রোধ আপনার বিরাট শক্র। এ শত্রুকে কখনও
ঘরে ঢুকতে দিতে নেই। আপনি সঠিক রাস্তায় থাকলে রেগে যাবার দরকারই হবে না,’ এরপর চোখ টিপে বলত সে, ‘ভুল কিছু করে বসলেও আপনার করার কিছু থাকবে না। রাগ করে কখনও যুদ্ধে জেতা যায়
না।’
একবার আমার
অফিসে বসে আছে হোসনী শাহ, এটা সেটা নিয়ে গল্প
করছে। আমি বললাম, ‘শাহজী, আপনার
রসবোধ আর অসীম ধৈর্যের আমি প্রশংসা করি। আপনাকে সবসময়ে সুখী আর হাসিখুশি দেখেছি।
তবে মাঝে মাঝে আপনাকে নিয়ে বেশ কৌতুহল হয়। আপনি কি কোনদিনই কারও উপর রাগ করেননি?’
হাসিটা মুছে
গেল হোসনী শাহ’র মুখ থেকে, ভাজ পড়ল কপালে। ‘হ্যা,’ গম্ভীর চেহারায় জবাব দিল সে যেন ভুলে যাওয়া অতীতের
কোনও স্মৃতি মনে পড়েছে। ‘হ্যা, একবার আমি রেগে গিয়েছিলাম।’
‘বলুন না সেই ঘটনা,’ অনুরোধ করলাম আমি। হোসনী শাহ আমার আহ্বানে সাড়া দিল। গলা খাকারি দিয়ে চেয়ারের কুশন ধরে মোচড়াতে লাগল।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরেক দিন। আরেকদিন আপনাকে বলব কেন আমি রেগে
গিয়েছিলাম আর রেগে গিয়ে বিয়েও করে ফেলি।’
আমাকে রহস্যের
মধ্যে রেখে চলে গেল সে। এরপর বেশ কিছুদিন পরে শুক্রবারের এক সন্ধ্যায় হোসনী শাহ’র সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আমার। বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমরা পরস্পরের কুশল
জিজ্ঞেস করলাম। নানা বিষয় নিয়ে গল্প হলো। হাঁটতে হাঁটতে ওর বাড়ির কাছে চলে এলাম।
আমি থেমে দাড়ালাম। বিদায় নেব। বেশ প্রফুল্ল মনে আছে হোসনী শাহ। আমার কাধে হাত রেখে
বলল, ‘সাহেবজী, আজ রাতে আমার সঙ্গে দুটো ডালভাত
খাবেন।’
আমি ইতস্তত
করছি দেখে মিষ্টি হাসল। ‘চলুন বন্ধু। শুক্রবার আমার জন্য শুভ দিন। এ দিনে আমার মন খুব ভাল থাকে। আমার
রেগে যাওয়ার গল্প আজ বলব। গল্পটা শোনার আগ্রহ ছিল আপনার। তা-ই না?’
আমি সঙ্গে
সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। হোসনী শাহ শহরের কেন্দ্রস্থলে বিরাট একটি বাড়িতে
থাকে। পুরানো ধাচে তৈরি বাড়ি। বেশ সাজানো। বাড়ির ভেতরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
উঠোনের মাঝখানে বড়বড় কয়েকটি ঘর। হোসনী শাহ তার পুরো পরিবার নিয়ে এখানে থাকে। সে, তার তরুণী স্ত্রী আর দুই সন্তান বাড়ির সামনের অংশটা দখল করেছে,
বড় ছেলে আর তার স্ত্রী তাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে থাকে উঠোনের শেষ
প্রান্তে! দুটি পরিবার একই রান্নাঘর ব্যবহার করে। সকল যৌথ পরিবারে তা-ই হয়ে আসছে।
আমাকে সামনের বড় ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। এ ঘরের জানালার কাচ রঙিন, রাস্তা দিয়ে দেখা যায়। অতিথি এলে ঘরটি একই সঙ্গে বৈঠকখানা এবং খাবার ঘর
হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরিচ্ছন্ন ঘরটিতে অল্প কিছু আসবাব। দেয়ালে সোনালি ফ্রেমের
বড় বড় রঙিন ছবি ঝুলছে, মেঝেতে লাল কার্পেট। একপাশে ধবধবে
সাদা একটি চাদর পেতে রাখা। তার উপর মুঘল ঢঙে প্রকাণ্ড একটি তাকিয়া। জুতো খুলে এ ঘরে ঢুকতে হলো।
হোসনী শাহ্
রাতের খাবারের হুকুম দিল। একটু পরে এক চাকর নিচু, সরু একটি টেবিল এনে তাকিয়ার সামনে রাখল। তারপর নিকেলের মুরদাবাড়ি বেসিন
এনে দরজার পাশে রেখে হাতে তোয়ালে আর জলের লোটা নিয়ে দাড়িয়ে থাকল। আমি হাত মুখ ধুয়ে
নিলাম। চাকর দুটো বড় রূপোর ট্রে নিয়ে এল তাতে ছ’সাতটি বাটিতে সাজানো সব্জির নানা পদ। মাংস নেই। হোসনী
শাহ নিরামিশাষী জানি। তাই এ জিনিসের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তবে একটা ব্যাপারের
জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তিন বাটি দই। তিন রকমের। প্রথম বাটিতে টক দই, দ্বিতীয়টিতে মিষ্টি, তৃতীয় বাটিতে
টক-মিষ্টি দই। আমি না বলে পারলাম না, ‘শাহজী, আপনি বোধহয় দই খুব পছন্দ করেন। জিনিসটা ভাল। তবে শুনেছি রাতে
দই খেতে নেই।’
‘দই আমি পছন্দ করি না। খুব কমই খাই,’ বলল হোসনী শাহ।
চুপ করে রইলাম
আমি বিষয়টি নিয়ে আর কথা বাড়ানো শোভন হবে না ভেবে খাওয়ায় মন দিলাম। আমার
নিমন্ত্রণকর্তা হঠাৎ ফেটে পড়ল হাসিতে। আমার বিব্রত ভাবটা উপভোগ করছে। বলল, ‘শুনে অবাক হয়েছেন, না? তবে এটাই সত্যি যে আমি খুবই কম দই খাই। যদিও প্রতিদিন
দু’বার করে তিনরকম দই
আমাকে দেয়া হয়। এ কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য আজ আপনাকে আমার বাড়িতে ডেকে এনেছি। আমি
কেন রেগে গিয়েছিলাম দইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।’
বলে নীরব হয়ে
গেল হোসনী শাহ, কিছুক্ষণ চুপচাপ খেয়ে গেল। বেশ আয়েশ
করে ধীর গতিতে খায় হোসনী শাহ। চাপাতির ছোট টুকরো ছিড়ে নিয়ে তাতে সবজি পেঁচিয়ে মুখে
পুরল। চাপাতি খাওয়া শেষ, মুখে এখনও খাবার, প্রথমে ধীর গতিতে কথা বলা শুরু করল সে, তারপর দ্রুত
হয়ে উঠল ভঙ্গি।
‘আপনি জানেন ব্যারিস্টার সাহেব, বলল হোসনী
শাহ, আপনাকে বহুবার বলেছি আল্লাহ আমাকে ঢেলে দিয়েছেন। একজন
মানুষ যা যা চায়, সবই পেয়েছি আমি-পুত্র, কন্যা (এদের দু’জনেরই ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছে) নাতি, লাভজনক ব্যবসা, চমৎকার একটি বাড়ি,
ভাল বন্ধুবান্ধব, সকলের কাছ থেকে সম্মান।
আলহামদু লিল্লাহ, আমার জীবনে অভাব বলে কিছু নেই। আমি ভাবি আমি আল্লাহর পছন্দের
মানুষ। প্রতিদিন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তার দয়া সবসময় আমার উপর বর্ষিত
হয়। আমার প্রথম স্ত্রী দেখতে সুন্দরী ছিল না, তবে তার মনটা
ছিল অত্যন্ত সুন্দর। আমার হৃদয় জয় করে নিয়েছিল সে। আমি তার কাছে ছিলাম ক্রীতদাসের
মত। তার মত স্নেহশীলা, নিঃস্বার্থ নারী জীবনে দু’টি দেখিনি আমি। আমাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবত সে, আমাকে খুশি করার জন্যে সর্বক্ষণ চেষ্টা করত সে। আমার গলার স্বর শুনেই বুঝে ফেলত আমি কী চাই, সন্ধ্যা বেলা দোকান থেকে ফিরে আসার পরে আমার হাতের সামান্য ইঙ্গিতেই
বুঝে নিত আমার কী দরকার। জানত কখন হাসতে হবে, কখন কী করতে
হবে। জানত আমি কী খেতে পছন্দ করি। সবসময় সে খাবার প্রস্তুত করে রাখত। আমার দিকে
এমনভাবে খেয়াল রাখত, অবাকই লাগত আমার। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে
আমার ব্যবসা এমন ফুলে-ফেঁপে ওঠে যে সাধারণ কাট-পিস ডিলার থেকে আমি শহরের অন্যতম
ধনী ব্যবসায়ীতে পরিণত হই। শৈশব কাটিয়েছি যে বাড়িতে সেটা ছেড়ে দিয়ে এ বাড়িটি তৈরি
করি আমরা। আল্লাহ আমাদেরকে একটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে উপহার দেন। আমরা ছেলের বিয়ে
দিই। পুত্রবধূ ঘরে এলে আমার স্ত্রী তার গহনার অর্ধেকটা দিয়ে দিয়েছিল নববধূকে। মেয়েটিকে
সে নিজের মেয়েদের চেয়েও বেশি ভালবাসত। আমাদের মেয়ে দুটিকেও সুপাত্রে, ভাল ঘরে বিয়ে
দিয়েছি। খুব শান্তিতে বাস করছিলাম আমরা। ঘরের শান্তি এবং সুখ কোনভাবেই বিঘ্নিত
হওয়ার অবকাশ ছিল না। কিন্তু আমার স্ত্রী যখন দশ বছর আগে, এক শীতে নিউমোনিয়ায় হঠাৎ মারা গেল, বাজ
ভেঙে পড়ল মাথায়। মনে হলো আমার সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে কোনও শয়তান আমার স্ত্রীকে কেড়ে
নিয়েছে আমার কাছ থেকে। প্রচণ্ড শোক এবং হতাশায় মুষড়ে পড়ি আমি, এমনভাবে আচরণ করতে থাকি যেন পৃথিবীর ধ্বংস চলে আসছে। দোকানে যেতাম না,
ছেলে পুরো ব্যবসার ভার নিয়ে নেয়। বাড়িতে সারাদিন নিস্তেজ হয়ে বসে
থাকতাম কিংবা রাতে একাকী হাঁটাহাঁটি করতাম। বন্ধুরা আমার সঙ্গে কথা বলত, ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইত মূর্খের মত আচরণ করছি আমি। ‘আল্লাহর ইচ্ছে ছিল
এটাই,’ বলত তারা। ‘কাজেই হতাশা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসো।
ছেলেমেয়েদের নিয়ে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করো।’ আমার বন্ধু চুনিলাল
বিয়ের কথা বলল। আবার বিয়ে করছি না কেন জিজ্ঞেস করল সে। যারা বউদেরকে খুব ভালবাসে তারা নাকি একা
থাকতে পারে না। স্ত্রীর শোক আমাকে ধ্বংস করে দেবে। যদি বেঁচে থাকতে চাই আর স্ত্রীর
স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চাই তাহলে তার জায়গায় কাউকে নিয়ে আসতে বলল। সে আরো বলল, ‘স্ত্রীর উপস্থিতি তোমাকে শান্ত করে তুলবে, তোমাকে সে ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে পারবে। প্রকৃতিগত ভাবেই তুমি
একজন যথার্থ স্বামী; আবার বিয়ে করো এবং পুরানোর বদলে নতুন
ভালবাসাকে নিয়ে উজ্জীবিত হও। দুঃখ ভুলে গিয়ে পুরুষ মানুষের মত হয়ে ওঠো। লোহার
ব্যবসায়ী আব্দুর রহিমের বিবাহযোগ্যা একটি কন্যা আছে। তোমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে
তার কোনও আপত্তি নেই।’
বলে চলেছে হোসনী
শাহ,‘সবাই যে যার মত করে
তাদের মতামত জানাতে লাগল। আমার কাছে কথাগুলো অর্থহীন মনে হচ্ছিল। আমি কী করে আমার
স্ত্রীর জায়গায় আরেকজনকে বসাব? ভাবতেই বিদ্রোহী
হয়ে উঠত মন। আমি বন্ধুদের অনুরোধ কিংবা পরামর্শ কানে তুলতাম না। বিয়ের সমস্ত
প্রস্তাব এক এক করে প্রত্যাখ্যান করে চলি আমি। ভাবতাম আমার পক্ষে বিয়ে করা কিছুতেই
সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহর কর্মকাণ্ড বড় রহস্যময়। জগতে যা ঘটে প্রতিটির
পিছনে কারণ থাকে। আমরা যা করি বা ভাবি সবই আমাদের কর্ম এবং তা আমরা করি ভবিষ্যৎ
জীবনের জন্য। কারও জীবনে খারাপ কিছু ঘটলে সেটাকে সে দুর্ভাগ্য বা নিয়তি বলে ধরে
নেয়। তবে আসল সত্য এটাই, সব কিছুই আল্লাহর পরিকল্পিত এবং আমাদের কর্মের অংশ।
‘তো আমার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটল। মাস যায়, ধীরে
ধীরে আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকি, আমার বেদনার মাত্রা কমতে
থাকে। আমার ছেলে এবং পুত্রবধূ আমাকে খুশি রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে। আমার
আরাম-আয়েশের প্রতি তাদের তীক্ষ্ণ নজর। তারা কাজ থেকে আমাকে ছুটি নিতে বলে। কিন্তু শোকের
প্রথম ধাক্কা খানিকটা সামলে ওঠার পরে ঘরে আর অলস বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। আমি
ফিরে এলাম দোকানে। কয়েকদিনের মধ্যে আবার মন দিলাম কাজে। এমনকী পুরনো দিনের মত
হাসি-ঠাট্টাও করতে লাগলাম। আমার বন্ধুরা এসব দেখে খুব খুশি।
একদিন দুপুরে
খেতে বসেছি। হঠাৎ মন চাইল দই খাব। খাওয়ার প্রতি খুব বেশি আকর্ষণ আমার নেই। তবে
সেদিন চিনি মিশিয়ে একটু দই খেতে কেন ইচ্ছে করল কে জানে। আগের দিন হলে, বউ বেঁচে থাকলে দই খাওয়ার বাসনা মুখ ফুটে বলারও দরকার হত না।
আমি কি চাই, বুঝে ফেলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। কিন্তু ছেলের বউ’র কাছে দই খেতে চাইলে সে বলল আজ দই বানাতে পারেনি।
দুর্ঘটনাক্রমে দুধটা পাত্র থেকে পুরোটাই পড়ে গেছে। আমি এ নিয়ে তাকে মন খারাপ করতে
নিষেধ করে নিজের খাওয়া শেষ করলাম।
‘আমি সারা জীবন চেষ্টা করেছি লোভ না করতে। গুণীজনরা বলেছেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে
লোভ জয় করার জন্য। আমি জানি, ব্যারিস্টার সাহেব,
এসব তত্ত্ব কথা আপনার কাছে হাস্যকর শোনাবে, আমাদের
ধর্মে আছে সুন্দরী নারীর মুখ দেখলে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে, যাতে
মনে কোনও কুভাবের জন্ম নিতে না পারে। আপনার ভিতরে খিদেবোধ হলে অনেক কিছু খেতে
ইচ্ছে করবে। সেক্ষেত্রে এ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে রোজা রাখা বা আপনাদের ধর্মের
উপবাস করা উচিত। কিন্তু আমরা সে কাজটি কখনোই করি না। ওহ, যেটা বলছিলাম, আমি নিশ্চয়
দই না খেতে পেয়ে একটু অসন্তুষ্ট ছিলাম, যে কারণে অর্ধেক পথ
যাওয়ার পর মনে পড়ল ক্যাশ বাক্সের চাবিটি বাড়িতে ফেলে এসেছি। আবার বাড়ির পথ ধরলাম।
মনে মনে নিজেকে তিরস্কারও করলাম। সামান্য দই খেতে না পেয়ে আমি এমন ভুলোমনা হয়ে গেলাম
কীভাবে। ঘরে ঢুকে দেখি আমার ছেলে আমার জায়গায় খেতে বসেছে। ওখানে ক্যাশ বাক্সের
চাবি রেখে গেছি। চাবি আনতে গিয়ে দেখে ফেললাম দৃশ্যটা। ওর থালার পাশে, প্রকাণ্ড একটা বাটিতে দই-কমপক্ষে চারজন খেতে পারবে। আমার
পুত্রবধু তার স্বামীর পাশেই দাঁড়ানো! ভয়ঙ্কর ক্রোধের একটা হল্কা উঠে এল শরীর বেয়ে;
পুত্রবধূর দিকে কটমট করে তাকালাম। প্রচণ্ড রাগে আমার মুখের কথা জড়িয়ে গেল, ‘তুমি বললে না যে দই নেই? সমস্ত দুধ পড়ে গেছে?’ আমার পুত্রবধূ বুঝতে পেরেছিল ভয়ানক রেগে গেছি আমি। আমাকে এ চেহারায় কোনওদিন দেখেনি সে। ভয়ে রীতিমত
কাঁপতে লাগল সে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল তারপর এক ছুটে পালিয়ে গেল রান্নাঘরে।
সামনে দইয়ের বাটি নিয়ে পাথর হয়ে বসে থাকল আমার ছেলে।
আল্লাহর
অনুগ্রহে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম আমি, চাবির
গোছা মুঠিতে পুরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।
‘দোকানে যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম আর কখনও ও বাড়িতে ফিরব না আমি। ব্যারিস্টার
সাহেব, আমি মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম, এ জন্য নিজেকে
ক্ষমা করতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম সামান্য দইয়ের জন্য কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটিয়ে
ফেলতে পারতাম। এরকম ঘটনা আবার ঘটলে ভয়াবহ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। আমি আমার
পুত্রবধূর গায়ে হাত তুলতে পারি। আমি-আমি এমনকী খুনও করে ফেলতে পারি। এসব চিন্তা
মাথায় আসার পরে দোকানে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। গেলাম বন্ধু পরশুরামের বাড়িতে।
জানতে চাইলাম লোহার ব্যবসায়ী আব্দুর রহিমের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে কিনা। না হয়ে
থাকলে আমার সঙ্গে বিয়ে দেবে কিনা। আমার কথা শুনে আনন্দের সঙ্গে পরশুরাম বলল আব্দুর রহিমের
মেয়ের বিয়ে এখনও হয়নি। সে তক্ষুনি আব্দুর রহিমের বাড়ি গেল। একঘণ্টার মধ্যে আব্দুর
রহিমের মেয়ের সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেল। আমি পরশুরামের বাড়িতেই থাকলাম।
দুইদিন পরে বিয়ে হয়ে গেল। বউ নিয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম।’
হোসনী শাহ
তাকিয়ায় হেলান দিল। কৌটা থেকে একটা পান নিয়ে মুখে পুরল। আমি গভীর একটি শ্বাস
ফেললাম-আমার আমন্ত্রণ কর্তার জন্য সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ। হোসনী শাহ কিছুক্ষণ পান
চিবানোর পরে বলল, ব্যারিস্টার সাহেব,
এই হলো আমার রেগে যাওয়া এবং বউ পাওয়ার গল্প।’
আমি সান্তনা
দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হোসনী শাহকে এমন
তৃপ্ত এবং সুখী লাগছে বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। তবে তিন রকমের দইয়ের রহস্য এখনও
আমার কাছে পরিষ্কার নয়। প্রতিদিন দু’বার তিনবাটি দই খেতে দেয়া হয় হোসনী শাহকে অথচ সে নাকি এগুলো ছুঁয়েও দেখে না। এ
ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করব কিনা ভাবছি। হোসনী শাহ হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়েছে, আমার উপস্থিতিও যেন ভুলে গেছে। নীরবতা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি
করল। সহ্য করতে না পেরে শেষে বলেই ফেললাম, ‘কিন্তু শাহজী, আপনি তো
তিন রকম দইয়ের রহস্য ব্যাখ্যা করলেন না?’
হাতের তালু
দিয়ে হাঁটু ঘষছিল হোসনী শাহ। থেমে গেল। মুচকি হাসল। ‘ব্যারিস্টার সাহেব, ওই দই আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি আমার পুত্রবধুর সঙ্গে অন্যায় আচরণ
করেছিলাম। নিজেকে ছোট্ট একটা শাস্তি দিই আমি এ জন্য। যখন দই খেতে ইচ্ছে করে না তখন জোর করে খাই। তবে
আমার চেয়েও বড় শাস্তি পেয়েছে আমার ছেলে আর তার বউ। দ্বিতীয় স্ত্রীর দৌলতে আমি দুটি
সন্তান পেয়েছি। আমার বড় ছেলেরই বেশিরভাগ সম্পত্তি পাবার কথা ছিল। কিন্তু সবাইকে
দিয়ে সে এখন যৎসামান্যই পাবে।’
হয়তো আমার
কল্পনা, তবে মনে হলো কথাটা বলার পরে হোসনী শাহ’র ঠোটে ফুটে উঠল শয়তানী একটা হাসি।
-----------------------------শেষ----------------------------------
লেখক পরিচিতি:
জি ডি খোসলার জন্ম ১৯০১ সালে, লাহোরে। পড়াশোনা
করেছেন ক্যামব্রিজে। ১৯২৫ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন তিনি। ১৯৪৪-এ পাঞ্জাব হাইকোর্টে
বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে এবং ১৯৫৯ সালে পাঞ্জাবের প্রধান বিচারক পদে
পদোন্নতি ঘটে। তিনি প্রচুর বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের
মধ্যে রয়েছে হিন্দু-মুসলিম রাজনীতি এবং ভারত ভাগের ঘটনা নিয়ে ‘স্টার্ন রেকডিং’, হিমালয়ের ভ্রমণ নিয়ে ‘ট্রাভেলস হিমালয়ান সার্কিট’, মহাত্মা গান্ধীর গুপ্তহত্যার উপর ভিত্তি
করে ‘মার্ডার অভ দা মহাত্মা’, উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট মুঘল’ এবং ছোট গল্পের সংকলন ‘দ্য হরস্কোপ ক্যান নট লাই’।
No comments:
Post a Comment