![]() |
সাপ ও শিকারী - ল্যাটিন আমেরিকার রুপকথা |
সাপ ও শিকারি - ল্যাটিন আমেরিকার রুপকথা
তখন গ্রীম্মকাল। প্রচণ্ড গরম। দিনের বেলা খারা রোদ। এমনই এক দিনে হঠাৎ শুরু হল দমকা বাতাস। সে বাতাসে গাছের দুটি মরা ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলে উঠল। ঝড়ো বাতাসে মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল সেই আগুন। আগুনে বনের একটা অংশের সব গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আগুনের উত্তাপে মারা গেল পশুপাখিদের বড় একটা অংশ। গরম থেকে বাচতে বনের সাপগুলো গর্তের গভীরে, একেবারে শেষ মাথায় চলে গেল।
বেশ কদিন জ্বলল এই আগুন। হয়তো আরও কিছুদিন জ্বলত। কিন্তু ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় তা একদিন নিভে গেল। আগুন নিভে যাওয়ায় উত্তাপও কমে এল। সাপগুলো তখন গর্ত ছেড়ে বের হয়ে আসতে লাগল।
একে একে সব সাপ বাইরে বের হয়ে এলেও একটা সাপ আটকে গেল। খাড়া গর্ত বেয়ে সে কোনোভাবেই উপরে উঠে আসতে পারল না। অন্য সাপগুলোর কাছে সে সাহায্য চাইল। অনেক অনুরোধ-অনুনয় করল। কিন্তু কেউই তাতে সাড়া দিল না। সাপটি ছিল একটু দুষ্ট প্রকৃতির। সুযোগ পেলেই সে অন্য সাপকে কামড়ে দিত। এ কারণে তার দুর্দশায় কারও মায়া হল না। সে আর কোনো সাপকে কামড়াবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিল। কিন্তু কেউ ঝুঁকি নিল না। একে একে তারা গর্তের উপরে উঠে গেল। এতে সাপটির বেশ মন খারাপ হল। কিছুটা ভয়ও পেল সে। তবে কি সে আর গর্ত থেকে বের হতে পারবে না? না পারলে খাবার জোটাবে কোথা থেকে? না খেতে পেয়ে গর্তেই মরে পড়ে থাকতে হবে।
দুদিন পর পোড়াবনে একজন শিকারি এলেন। হেঁটে যাওয়ার সময় তিনি গর্তের ভেতর সাপের গোঙানি শুনলেন। অভিজ্ঞ শিকারি বুঝতে পারলেন সাপটি বিপদে পড়েছে। গর্ত খুঁড়ে তিনি সাপকে বাইরে বের করে আনলেন। মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সজেই দুষ্ট সাপ শিকারিকে ছোবল মারতে উদ্যত হল।
তাই দেখে দ্রুত একটু সরে গেলেন তিনি। সাপের উদ্দেশে বললেন, “তুমি আমাকে কামড়াতে পার না। কারণ আমি তোমাকে গর্তের ভেতর থেকে বের করে এনেছি।”
এই কথায় মন গলল না নিষ্ঠুর সাপের। সে শিকারিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “কেন আমি তোমাকে কামড়াতে পারি না তা একটু ব্যাখ্যা করো তো।”
“কারণ যে তোমার উপকার করে, তার কোনো ক্ষতি তুমি করতে পার না,” বললেন শিকারি।
“কিন্তু কী করে বুঝব যে সবাই একই রকম আচরণ করবে,” প্যাচ কষার চেষ্টা করল সাপ।
“চলো, তাহলে এক কাজ করা যাক। বিষয়টা একজন বিচারকের উপর ছেড়ে দেই। দেখি তিনি কী বলেন।”
শিকারির এই প্রস্তাব মেনে নিল সাপ। দুজনে সামনে এগিয়ে গেল। যাওয়ার পথে পড়ল একটা ঘোড়া। শিকারি ও সাপ ঘোড়াকে ঘটনার পুরোটা বলল। তারপর ঘোড়ার মতামত জানতে চাইল।
ঘোড়া বলল, সে ব্যক্তিগতভাবে মানুষের উপকারের বিষয়ে তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু ভালো আচরণের প্রতিদান পায় না। উল্টো লোকেরা তাকে চাবুকে জর্জরিত করে।
একটু পরেই একটা বানরের সঙ্গে দেখা। তাকেও পুরো ঘটনা খলে বলা হল। এরপর তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হল।
বানরও একই উত্তর দিল। সে বলল,
সে মানুষকে নাচ দেখিয়ে আনন্দ দেয়। কিন্তু মানুষ মাঝেমধ্যেই বেত দিয়ে তাকে পেটায়।
এবার তারা একটি গাভির মুখোমুখি হল। আগের মতোই গাভিকে পুরো বিষয়টা খুলে বলা হল। গাভি উত্তর দিল, মানুষের প্রতি ভালো আচরণের প্রতিদান হিসেবে তাকে যে কোনো সময় জবাই করা হতে পারে।
এতে বিজয়ীর হাসি ফুটল সাপের মুখে। সে মাথা উচু করে শিকারিকে ছোবল মারতে উদ্যত হল।
শিকারি একটু দ্রুত সরে গেল। তারপর সাপের উদ্দেশ্যে বলল, “আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে মোটেও একমত নই। চলো, শেষ চেষ্টা হিসেবে আনানসির কাছে যাই। তিনি অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয়ই সুবিচার করবেন। তার মতামত আমি বিনা যুক্তিতে মেনে নেব।”
সাপ এই প্রস্তাবে সম্মত হল। দুজনই শহরে এল। আনানসিকে বাসাতেই পাওয়া গেল। তারা আনানসির কাছে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ দিয়ে তার পরামর্শ চাইল।
সব শুনে বেশ গন্তীর হয়ে গেলেন আনানসি। তাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। আনমনে তিনি মাথা দোলাতে লাগলেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মুখ খুললেন, “বিষয়টা বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। কে যে ঠিক,
আর কে যে ভুল বলছে,
তা আমি বুঝতে পারছি না। তবে ঘটনাবলি কীভাবে ঘটেছে তা দেখলে হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার হতে পারে।”
বেশ তো, একসঙ্গে বলে উঠল সাপ ও শিকারি। তারপর তারা তিনজনই ওই গর্তটির কাছে ফিরে গেল, যেখান থেকে সাপকে উদ্ধার করেছিল শিকারি। কীভাবে কী ঘটেছে তা গোড়া থেকে দেখাতে সাপ গর্তে নেমে গেল। সেখান থেকে সে সাহায্যের জন্য চিৎকার শুরু করল। এই চিৎকারে সাড়া দিয়ে শিকারি ওকে উদ্ধারে উদ্যত হল, যেমনটি সে আগেরবার করেছিল।
তবে এবার আর সাপকে উদ্ধার করা হল না। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিল আনানসি। “অপেক্ষা করো। আমি এখনই তোমাদের বিরোধের নিষ্পত্তি করে দেব। শিকারির এবার সাপকে উদ্ধার করা উচিত হবে না। কারও সহায়তা ছাড়াই গর্ত থেকে ওঠে আসার চেষ্টা করুক সে, যাতে কাউকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার মতো কাজ কতটা মহৎ সে বুঝতে পারে।”
সাপকে তাই গর্তেই আটকে থাকতে হল। একসময় তার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেল। আর ওই ক্ষুধা নিয়েই তাকে কয়েকদিন ধরে গর্ত থেকে বেরোনোর চেষ্টা চালাতে হল। অনেক চেষ্টার পর সফল হল সে।
কিছুদিন পর একটা ঘটনা ঘটল। বনের কাঠ চুরির অভিযোগে শিকারিকে আটক করে জেলে পাঠানো হল। এই খবর আসতেই সাপের মনটা কেমন করে উঠল। তাকে মহাবিপদে গর্ত থেকে উদ্ধার করেছিল শিকারি; তার ঘোর বিপদে তাই হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে।
দ্রুত সে ছুটে চলল রাজপ্রাসাদের দিকে। অনেক ভেবে সে একটা উপায় খুঁজে বের করল। চুপিচুপি রাজপ্রাসাদে ঢুকে সুযোগমতো রাজাকে কামড়ে দিল সে। আর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চুপিচুপি রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল।
এবার জেলখানার দিকে ছুটল। সহজেই কারাগারে প্রবেশের একটা ছোট ছিদ্র খুজে পেল। সে শিকারিকে আশ্বস্ত করল। এতে শিকারির ভয় খানিকটা কমল। শিকারিকে সাপ বলল, “অনেক দিন আগে তুমি বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি তার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। এ কারণেই আমি তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি। শোনো, আমি একটু আগে রাজাকে কামড়ে দিয়েছি। আর এটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। তুমি রাজপরিবারের কাছে একটা খবর পাঠাও। তাদের জানাও, রাজাকে তুমি ভালো করতে পারবে। তবে তার জন্য একটা শর্ত দিয়ো। রাজার একমাত্র কন্যাকে তোমার কাছে বিয়ে দিলেই কেবল তুমি তাকে সারিয়ে তুলবে।”
রাজাকে বিষমুক্ত করার উপায়ও বাতলে দিল সে। দিল তিন রকমের লতাপাতা। সাপের পরামর্শ অনুসারে সবকিছু করল শিকারি।
সাপের বিষের তীব্রতায় নীল হয়ে পড়েছিল রাজার সারা শরীর। সবাই ধরে নিয়েছিল, এ বিষ কাটবে না। রাজা আর বাঁচবেন না। প্রজাদের ফেলে রেখে এত আগে চলে যেতে হবে, একমাত্র কন্যার বিয়েটাও দেখে যেতে পারবেন না-এসব ভেবে রাজা ভেঙে পড়েছিলেন। তাই তিনি শিকারির সব শর্ত মেনে নিতে একটুও দ্বিধা করলেন না। প্রস্তাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাতে রাজি হয়ে গেলেন।
রাজাকে সাপের দেয়া লতাপাতা খাইয়ে বিষমুক্ত করলেন শিকারি। প্রতিশ্রুতি রাখলেন রাজা। মহাধুমধাম করে রাজকন্যাকে তার কাছে বিয়ে দিলেন। তারপর থেকে সুখেই কাটতে লাগল শিকারির দিনকাল।
Maruf Al Mahmood
Maruf Al Mahmood
No comments:
Post a Comment