![]() |
রোমহর্ষক শিকারের গল্প - মৃত্যুর হানা রাত্রে - Norah Burke |
রোমহর্ষক
শিকারের গল্প - মৃত্যুর হানা রাত্রে
তত
হলে আসুন,
দুজনে একটু বসা যাক এখানে। তারপর বলব, কেন আমি ছাগলটা বিক্রি করব না আপনাকে।
হ্যা, ওই ছাঁগলটা- ওই যে- যেটা গলায় পেতলের গয়না পরে
ঝুমঝুমিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে
পেয়েছেন তো। হ্যা, ওটার কথাই বলছি। আর ওই যে ছোট্ট কুকুরটা-হাঁ
করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে- ওটাকেও দেব না। তা সে আপনি পাঁচ বা পঞ্চাশ যত
টাকাই দিতে চান না কেন?
যদিও
ওটা রাস্তার কুকুর। আমি কোনদিনই ওটার মালিক
ছিলাম না। তবু। আমার অবস্থা তো দেখছেন, নিতান্ত গরিব মানুষ। এই লাঠি, টুপি আর গায়ে দেয়ার কম্বলটা ছাড়া কিছুই নেই
আমার। হিমালয়ের পথে পথে ঘুরেই আমার জীবন গেল। যদিও এক রাতের বেশি কোনদিনই কাটাইনি
কোথাও।
ভাল,
ভাল, খুব ভাল। তা বসবেন কোথায়? এই পাথরটার ওপর বসতে কি
খুব কষ্ট হবে? আচ্ছা দাঁড়ান, ওই ফার্ন
গাছটার একটা ডাল কেটে এনে পেতে দিই এটার ওপর। তাহলে আর অসুবিধে হবে না বসতে।
এখন
উল বুনতে বুনতে আপনার সঙ্গে কথা বলব আর নজর রাখব আমার ভেড়া ছাগলগুলোর ওপর। না, ওরা
দূরে কোথাও পালাবে না, সব এখানেই থাকবে। আসলে এখানকার ঘাস
খুব মিঠে। হয়তো মাটি ভিজে বলেই। তাই এখানটায় চরে বেড়াতে ওরা খুব ভালোবাসে।
তাছাড়া এখানকার রডোডেনড্রনগুলোকে লক্ষ্য করে দেখেছেন? অন্য সব
জায়গার তুলনায় অনেক বড় নয়? দেখুন না, কেমন দৈত্যের মতো মাথা উঁচিয়ে রয়েছে নীল আকাশের দিকে। বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে দেখুন-একটুও নোংরা গন্ধ পাবেন না। বিশেষ করে বাজার
অঞ্চলের কোনো গন্ধই পাবেন না। আর চার পাশটা লক্ষ্য করে দেখুন- পাহাড় ছাড়া আর
কিছুই চোখে পড়বে না।
কোকরিঘাট
থেকে যেদিন চিরকালের জনে বেরিয়ে পড়ি সেদিনটাও ঠিক এমনি ছিল। গরিব লোক আমি।
জিনিসপত্র নেবার বলতে আর কিই বা ছিল আমার? কিছু গুড় আর নুন। তা
সেগুলো আগেই ভরে রেখেছিলাম ঝোলাতে। ছাগল ভেড়ার পিঠে চাঁপিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম
বাড়ি থেকে। চড়াই উত্রাই আর গ্রাম পেরিয়ে হাটতে শুরু করেছিলাম হিমালয়ের পথে
পথে।
না
না, তা বলে ভাববেন না আমি নিঃসঙ্গ। আমি একেবারে একলা। পথ চলতে
কত লোকের সঙ্গে দেখা হয়। গল্প করি তাদের সঙ্গে। বাজারের যে রাস্তাটার দু’পাশে ফল আর
গয়নার্গাঁটির দোকান, ওরা সবাই আমার চেনা। যখন যাই, তখন কথা বলি তাদের সঙ্গে। এমনকি বাজারের পেছন দিকটায় যারা বসে তাআও আমার
অপরিচিত নয়। তাঁদের কেউ কেউ বেচে শিরাজ
কম্বল, উল, কাশ্মীরী সিল্ক। কেউ কেউ বা
আহমেদাবাদ বা কানপুর থেকে আনে সুতির কাপডচোপর। জয়পুরের পেতল বাসনও বিক্রি করে কেউ
কেউ। তাদের সকলের সঙ্গে আমার পণ্য বিনিময় হয়। ওখানকার মেয়েরাও কেউ আমার অচেনা
নয়। কেউ কেউ আবার আমাকে গেঁও বলে। এটা সেটা নিয়ে মস্করা করে। আমি কিছু বলি না
কেবল হাসি।
ও
হ্যা,
বলতে ভুলে গেছি, আমার বউ ছেলেমেয়েও ছিল। ছিল
রীতিমতো সাজানো গোছানো সংসার। কিন্তু এক সময় কোকরিঘাটে এমন এক মড়ক এল যে-(দীর্ঘশ্বাস)।
ছাগল-ভেড়ার
এই যে পাল দেখছেন সামনে, এখন এদের নিয়েই আমার সংসার। শুনতে অদ্ভুত লাগছে তাই না? কিন্ত কি আর করা যাবে?
পেতলের ঘণ্টা বাঁধা ওই ছাগলটা দেখছেন, ওটা আর
ওই বেঁটে গুড়গুড়ে কুকুরটা, ও দুটোই সবথেকে পুরনো। ওদের
নিয়ে এমন সব দুর্গম পথে গেছি যে, সেখানে উট নিয়েও কোনো
ব্যবসায়ী পৌছতে পারেনি। কেন যাব
না? এদিকে বাঁধা আমার ওই কুকুরদুটো লক্ষ্য করেছেন? একেবারে
বাঘের মতো। কোনো অচেনা মানুষ যদি হঠাৎ ওদের সামনে পড়ে, তাহলে
আর রক্ষে নেই। জান নিয়ে নেবে। আর সেইজন্য, আপনি হঠাৎ সামনে
এসে পড়াতে ডেকে বসিয়েছি। বড় কথা হলো, আমার ডাকে সাড়া
দিয়ে আপনিও এসে বসেছেন। নাহলে একটা কেলেঙ্কারি ঘটে যেতে পারত।
ওই
যে উঁচু পাহাড়টা দেখছেন? ওই যে যেখানে নীল আফিম গাছগুলো তাদের ডালপালা
ছড়িয়ে হাওয়ায় দুলছে। সেদিন আমি ওখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সে সময় ওই ছোট্ট
কুকুরটা আমার দলে আসেনি। তখন ওই শিকারি বাঘা দুটোই থাকত আমার সঙ্গে। কোথা থেকে
হঠাৎ একটা ঢিল এসে আমার পাশে পড়েই গড়িয়ে গেল নিচের দিকে।
কি
হলো? চোখ ফেরাতেই দেখলাম, এক পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের ছোকরা।
পরনে খাকি প্যান্ট শার্ট। ছাগলের মতো গুড়ি মেরে পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে আমার দিকে।
তার পেছনে তার আর্দালি। তার হাতে রাইফেল আর কার্তুজের ঝোলা ব্যাগ। না জানি কে?
“আরে তোমাকে
ধরবার জন্যেই আমি পিছু পিছু ছুটে আসছি,” বলতে বলতে
সে ছোকরা সামনে এসে দাঁড়াল। কোকরিঘাটের মোড়ল বলল, “তুমি নাকি ছাগল
বিক্রি কর। কিছুদিন হলো একটা চিতা এ অঞ্চলে খুব উৎপাত শুরু করেছে। কয়েকজনকে বেশ ঘায়েলও
করেছে। পাকাপোক্ত মানুষ-খেকো হয়ে ওঠার আগে শয়তানটাকে খতম করা দরকার। তুমি একটা ছাগল দাও, যেটা বেশ ডাকবে। আমি সেটাকে টোপ হিসেবে গাছের নিচে বাধব।”
“সত্যিকারের
এই যদি কারণ হয়, তাহলে ছাগল দেব।” বললাম আমি।– “যদিও দেবার
মতো তেমন
নেই
উপস্থিত।”
“কিস্ত মনে
থাকে যেন,
ডাকবে এমন .ছাঁগলই আমার দরকার। এমন দিও না, যে
কেবল মাচার তলায় বসে খাবে, আর নাক ডাকিয়ে ঘুমোবে সারারাত।”
“ঠিক অমন
ধরনেরই একটা আছে।” বলে ওই পেতলের গয়না পরা ছাগলটাকে
দেখিয়ে দিলাম। পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে ওটা তখন গুঁতোগুঁতি করছিল সঙ্গীদের
সঙ্গে। ইয়া লম্বা লম্বা লোম, সূর্যের আলোয় ঝকমক করছিল তখন।
“বেশ কয়েক
বছর ওটা আছে আমাদের সঙ্গে। ওটাকে যদি নিয়ে যান, সঙ্গছাড়া হয়ে
নিশ্চয় ওটার মন খারাপ হবে। হাকডাক ফেলে দেবে মাচার নিচে। ফলে চিতাটা যত দূরেই থাক,
ওর ডাকে এসে দাড়াবে আপনার রাইফেলের সামনে।”
“ঠিক আছে।
তাহলে ওটাই নেব। এক কথায় রাজী হয়ে গেল ছোকরা।” একে উঠতি বয়েস, তায়
শিকারে উৎসাহী। মেজাজ একেবারে শরীফ।
জিজ্ঞেস
করল, “এবারে বল, কত
দিতে হবে ওটার জন্যে। নিশ্চয় খুব একটা বেশি নয়। তেমন কচি
বয়সের
নধর একটা কিছু হলে না হয় কথা ছিল।”
দর
কষাকষি চলল কিছুক্ষণ।
শেষে
বললাম,
“না বাবু, অত
কম দামে আমি দিতে পারব না। তুমি বরং তোমার কুকুরটাকে মাচার
তলায়
বাঁধো।”
বলে
পিছু পিছু ছুটে আসা কুকুক্রটাকে দেখিয়ে দিলাম। “দুবেলা
দু-মুঠো পেটে দেবার জন্যই এ কাজ করি। ঠিক ঠিক দাম না পেলে আমার চলবে কিভাবে?”
ছোকরা
এবার পিছু ফিরে দেখল কুকুরটাকে। বলল, “ওটা আমার
কুকুর নয়। রাস্তার বেওয়ারিশ জীব। বোধহয়
একটা মালিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। গ্রাম থেকে রওনা হবার সময় আমার পিছু নিয়েছে। ইচ্ছে করলে
এখুনি একটি গুলিতে শেষ করে দিতে পারি। কিন্তু তাতে আমারই ক্ষতি। রাইফেলের আওয়াজ শুনতে
পেলে চিতাটা হয়তো তল্লাট ছেড়ে পালাবে। আজ রাত্রের সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।”
“তাহলে
ওটাকে কোথাও বেঁধে রাখো।”
“অনেক
চেষ্টা করেছি, ধরতে পাঁরিনি। ব্যাটা বাদরের থেকেও চটপটে। ধরতে গেলেই
পালাচ্ছে অথচ পেছনে আঠার মতো লেগে আছে। যদিও মনে করি ওটা এক সময় ওর নিজের গ্রামেই
ফিরে যাবে।”
ছোকরা
একটা টিল কুড়িয়ে নিতে গেল মাটি থেকে। আর তাই
দেখে লেজ গুটিয়ে দৌড় দিল কুকুরটা।
যাই
হোক, শেষ পর্যন্ত দিয়েই দিলাম ছাগলটা।
আসল
দাম যা,
তার থেকে একটু বেশিই পেলাম। মুখে এমন একটা ভাব দেখালাম যেন দামটা
মোটেই মনঃপূত হয়নি। ছোকরা বিদায় হলো। তার আর্দালি ছাগলটাকে তাড়িয়ে চলল পিছু
পিছু। আমার আর সব ছাগল-ভেড়াগুলোর ঘাস খাওয়া শেষ হলে আমিও পাততাড়ি গুটোলাম। রওনা
হলাম সেখান থেকে।
মাইল
খানেক যাবার পর বড় রাস্তার ওপর একটা ফসল কাটা ক্ষেত চোখে পড়ল। চারপাশটা কাটা গাছের
বেড়া দিয়ে ঘেরা। এ ধরনের জমির মালিক আমাদের খুব পছন্দ করে। পশুর পাল নিয়ে আমরা যদি
তাদের জমিতে একটা রাত কাটাই, তাতে তাদের জমির উর্বরতা বাড়ে। জমিতে
সার দেওয়ার কাজটা আমার পশুরা আপনা হতেই করে দেয়। আপনি যখন এ অঞ্চলে ঘুরছেন,
তখন এমন জমি নিশ্চয় আপনার চোখে পড়েছে। সন্ধে হয় হয় সময়। লক্ষ্য
করে দেখলাম, কাটা গাছের বেড়াটাও বেশ মজবুত। ঠিক করলাম পশু-গুলোকে
নিয়ে সেখানেই রাত কাটাব। তারপর আকাশে ভুটিয়া তারা দেখা দিলেই রওনা হয়ে পড়ব।
চিতা
বাঘের কথাটা মনে এল। তা বলে যে খুব ভাবনায় পড়লাম এমন নয়। সঙ্গে আমার দু-দুটো
বড় জাতের শিকারি কুকুর। কিসের ভয়? যদিও শুনেছি শয়তানটা এ
অঞ্চলেই উৎপাত করে বেড়াচ্ছে। অথচ এ বয়েসে সেই কথাটা আমার অজানা নয় যে, ভয়ই মৃত্যুকে কাছে ডেকে আনে। যে কারণে ভয় পাওয়াটা মোটেই কোনো কাজের কথা
নয়। সুতরাং কাজে লেগে গেলাম। বেড়াটার যে জায়গাগুলো একটু কমজোরী বলে মনে হলো, সেগুলো মেরামত করে নিলাম। অন্য জায়গা থেকে ডালপালা কেটে এনে চাপিয়ে
দিলাম জায়গা-গুলোতে। মশাল বানাবার জন্যে কেটে আনলাম একটা পাইন গাছের ডাল। সারারাত
আগুন জ্বালাবার জন্যে জড় করলাম শুকনো কাঠকুটো। তারপর দুটো শিকারি কুকুর আর পশুগুলোকে
নিয়ে ঢুকে পড়লাম চৌহদ্দির ভেতর। শক্ত করে বন্ধ করে দিলাম আগড়টা।
সেদিনকার
মতো কুকুর দুটোর বাঁধন খুলে দিতে গেলাম। যাতে ওরা নিজেদের ইচ্ছেমতো জায়গায় বসে
নজর রাখতে পারে পশুগুলোর- ওপর। কিন্তু তারপরই মনে হলো, না।
সেটা ঠিক হবে না। ক্ষেতি জমিটা একেবারে বড় রাস্তার ওপর। হঠাৎ কোন মানুষ ধারে কাছে
এসে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। চোর ডাকাত সন্দেহ করে কুকুর দুটো তখনি ঝাপিয়ে পড়বে।
এ ধরনের সাত পাঁচ কথা ভেবে, ওদের গলার চেন আর আলগা করলাম না।
পশুগুলোকে জমির মাঝখানে রেখে কুকুর দুটোকে দুদিকে বেঁধে দিলাম। আর একদিকে বেড়ার
ধার ধেঁষে আমি নিজে রইলাম। চারপাশ ঘিরে রইল কাঁটাগাছের বেড়া। ফাকা রইল শুধু একটা
দিক। তেমন তেমন হিংস্র জানোয়ার যদি এসেও পড়ে, তাহলে সেটা
আসবে ওই ফাঁকা দিক দিয়েই।
নিজে
যেখানটায় থাকব ঠিক তার পাশেই আগুন জালালাম। তারপর চাপাটি তৈরি করে দুধ আর মাখন
সহযোগে
রাতের খাওয়া খেয়ে নিলাম গরম গরম।
রাত
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডাও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। চাঁদ ওঠার আগে পর্যন্ত চারদিকে
কালিগোলা অন্ধকার। শুধু মশাল আর চুল্লির আলোয় একটা রহস্যময় আলো-আধাঁরির খেলা।
কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ার আগে উঠে দড়ালাম। একবার চারদিক ভাল করে নজর বুলিয়ে
নেওয়া দরকার। বলা যায় না আলো-ছায়ার
আড়ালে হয়তো কোনো মহা শত্রু গা-ঢাকা দিয়ে আছে।
ছোকরা
শিকারিকে যে ছাগলটা দিয়েছি সেটার ডাক শোনার জন্য কান পাতলাম। কিন্তু না, কোনো
ডাকই কানে এল না। শুধু আমার কুকুর দুটোর চেনের নড়াচড়া আর পশুগুলোর গলার ঝুমঝুমির
ঠুনঠান ছাড়া আর কিছুই কানে এল না। সেই ছাগলটার না ডাকার কারণ আমি পরে বুঝতে
পেরেছিলাম। শিকারি ছোকরাটা
একেবারে আনকোরা, কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। তাই ছাগলটাকে মাচার নিচে বেঁধে,
পরে বাবু ওপরে উঠেছিল। ভেবেছিল, ছাগল যেমন
ডাকে, তেমনি ডাকবে, আর চিতাটা গুটি গুটি
এসে হাজির হবে সামনে। তার উচিত ছিল, ছাগলটার অলক্ষ্যে মাচার ওপর
ওঠা। তারপর কাউকে দিয়ে টোপটা বাঁধিয়ে নেওয়া। ছাগলটা ডাকেনি, তার কারণ সে তো জানে মাচার ওপর মানুষ আছে। অতএব নিশ্চিন্তে ঘাড় গুঁজে
সেটা ঘুমোতে শুরু করেছিল।
কতক্ষণ
ঘুমিয়েছিলাম জানি না, আমার কুকুর দুটোর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। আমার জ্বালা আগুন আর মশাল ততক্ষণে নিভে গেছে। সুন্দর চাঁদের
আলোয় ধবধব করছে চারদিক। দেখলাম, বেড়ার যে জায়গাটা একটু
খারাপ ছিল, ডালপালা দিয়ে যে জায়গাটা আড়াল দিয়েছিলাম,
সে জায়গাটা নড়ছে। বাইরে থেকে কোনো একটা জানোয়ার ভেতরে আসার
চেষ্টা করছে। সত্যি কথা বলতে কি, রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম।
সেদিনকার
বোকামির কথা ভাবলে এখন লজ্জা লাগে। আমি, মানে একটা সুস্থ সবল মানুষ,
জাগ্রত অবস্থায় হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে, বাঘের মতো দু- দুটো শিকারি কুকুর, হলোই বা চেন দিয়ে
বাঁধা। তাতে কি হয়েছে, চিৎকার করছে গলা ছেড়ে, আর আমি কি করছি? না একটা ছায়ার নড়নচড়ন দেখে ভয়ে
কাপছি থরথর করে।
পরে
ভেবে দেখেছি, এর পেছনে সেই ছোকরা শিকারির মন্তব্যটা কাজ করেছিল। সে
বলেছিল, “পাকাপোক্ত
মানুষ-খেকো হওয়ার আগেই চিতাটাকে খতম করা দরকার।” শিউরে
উঠলাম। শুকিয়ে গেল অন্তরাত্মা।
ছুটে
গিয়ে আমার কুকুর দুটোর চেন খুলব, এমন সময়ে বেড়ার ফাক গলে জানোয়ারটা ঢুকে গেল
ভেতরে। দেখলাম চিতা নয়, সেই বেওয়ারিশ কুকুরটা, ছোকরা শিকারির পিছু পিছু যেটা গ্রাম থেকে চলে এসেছিল।
আজ
মুখ ফুটে এ কথা বলতে লজ্জা করে। তবে কি জানেন, চাঁদের আলোয় এসব জায়গায়
এমনিই হয়; ছায়ার নড়াচড়ার মধ্যে মানুষ অনেক বিভ্রম দেখে। আমার
নিজেরই একবার বিরড়ালকে বাঘ বলে মনে হয়েছিল।
চারপাশে
প্রচুর পাথর পড়েছিল। ইচ্ছে করলে ছুড়ে আপদটাকে জমির বার করে দিতে পারতাম। কিন্তু
ভয় পাওয়ার জন্যে নিজে এত লজ্জা পেয়েছিলাম যে, কুকুরটাকে তাড়াতে
মন চাইল না। ভাবলাম, ওটাও তো আমার মতো ভয় পেয়েছে। আসুক,
ভেতরেই আসুক। হাতের অস্ত্রটা ফেলে দিতেই কুকুরটা লেজ গুটিয়ে কুঁই
কুঁই করতে করতে সামনে এসে দাঁড়াল।
এরপর
যা করলাম,
তা বিশ্বাস হবে না আপনার। এরপর ভাল করে খাওয়ালাম কুকুরটাকে। হ্যাঁ, আমার নিজের খাবার, সকালের জন্যে যা রেখে দিয়েছিলাম,
সব তাকে ধরে দিয়ে, কম্বল জড়িয়ে শুয়ে
পড়লাম। অনেক পরে খাওয়া সেরে কুকুরটা আবার আমারই কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়ল। শুয়ে পড়ল
আমার গা ঘেঁষে। গায়ে গা লাগতে দেখলাম, ঠাণ্ডায় সেটা তখনও কাঁপছে
থরথর করে। কিছু পরে দু-জনেই ঘুমিয়ে গড়লাম।
কতক্ষণ
পরে জানি না, হঠাৎ কিসের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। পরে পরেই প্রচণ্ড গর্জন
করে একটা জানোয়ার ধরল আমার হাতটা। কুকুরটা যেখান দিয়ে ঢুকেছে, সেখান দিয়ে মুখ গলিয়ে কামড়ে ধরে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে বাইরে।
ভেতরে ঢোকেনি শুধু শিকারি কুকুর দুটোর ভয়ে। সে জানে বাঘা দুটো ভেতরে। হাতটা
কামড়ে ধরতেই আমি লাফ দিয়ে উঠে বসেছি।
ধান্দা
তার একটাই। আমাকে বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে মেরে, অন্য কোথাও বয়ে নিয়ে
যাওয়া।
একটা
হাত ফাকা ছিল। সেটা দিয়ে কাটা গাছের গোড়াগুলো চেপে ধরে চিৎকার শুরু করলাম আমার বাঘা
দুটোর উদ্দেশ্যে। ঘাউ ঘাউ করে উঠল সে দুটো। শেকল ছেঁড়ার জন্য লম্ফঝম্ফ শুরু করে
দিল। বাকি পশুগুলো ভয় পেয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল মাঝের জমিটায়।
জানেন
কিনা জানি না, একটা চিতাবাঘের হিম্মত কিছু কম নয়। একটা আস্ত গরুকে মেরে
বয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখে। আর আমার হাতটা শয়তানটা বেশ কায়দা করেই কামড়েছিল।
মানুষ
হিসেবে আমিও কিছু দুর্বল নই। টিকে থাকার লড়াই শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে।
চুল্লিটা থেকে একটা পোড়া কাঠ বা মশালটা নিতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু নেব কি করে, দুটো
হাতই তো জোড়া। শুধু তাই নয়, একসময়
দেখলাম চিতাটার টানে কাঁটাগাছের গোড়াগুলো উপড়ে আসছে। শেকড় ছিড়তে শুরু করেছে
একটার পর একটা। আর আমিও বাইরের
দিকে এগিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে।
আঙুল
দিয়ে সজোরে চেপে ধরলাম পাথুরে মাটি। নখগুলোর অর্ধেক প্রায় উঠে যাবার দশা হলো।
তবুও রুখতে পারলাম না নিজেকে। শয়তানটার টানে আমার মুখ গিয়ে পড়ল কাঁটা ঝোপের
ওপর। ছড়ে কেটে গেল মুখটা।
এই
অবস্থায় কম্বলটার ভেতর আটকা পড়ে বেওয়ারিশ কুকুরটার তখন দম বন্ধ হবার অবস্থা। অতি
কষ্টে হাঁচড-পাঁচড় করে সে বেরিয়ে এল বাইরে। আর তখনি দেখতে পেল আমার দৃশ্য।
এক
মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সটান ঝাপিয়ে পড়ল চিতাটার ওপর।
ওর
মতো সামান্য একটা কুকুর, অতবড় চিতাটার কি এমন ক্ষতি করতে পারে?
থাবার একটা ঘায়েই কুকুরটার ভবলীলা শেষ করে দিতে পারে চিতাটা। কিন্তু
কুকুরটা খুব চালাক। চিতাটার মুখের ওপর শুধু লাফালাফি শুরু করে দিল। একবার এদিক তো পরমুহূর্তেই
ওদিক। ঠিক গোখরো সাপের ওপর নেউলরা যা করে।
বোধহয়
চিমটি কাটার মতো কোথাও একটু লেগেছিল চিতাটার। মেজাজ চড়ে গেল। দারুণ রোষে কামড়াতে
গেল কুকুরটাকে।
ব্যস!
এই এক সুযোগেই আমি আমার হাতটা টেনে নিলাম চিতার মুখ থেকে। যদিও আমার প্রায় জ্ঞানশূন্য
অবস্থা। তবুও গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়লাম আগুনটার পাশে। একটা জলন্ত পোড়া কাঠ নিয়ে ছুঁড়ে
দিলাম চিতাটার মাথা লক্ষ করে।
একলাফে
কয়েক পা পিছিয়ে গেল আপদটা। হলে হবে কি, পিঠ দেখাল না মোটেই। চাঁদের
আলোয় সে ব্যাটাকে ঝোপের পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখলাম। বেড়ার ফাক ফোকর খুজে বের করার ধান্দা।
সেখান দিয়ে সে আবার ঢুকতে পারে ভেতরে।
শিকারি
কুকুর দুটোর শিকল খুলে দেবার জন্য টলতে টলতে এগিয়ে চললাম। বেওয়ারিশ ছোট্ট কুকুরটাও
আমার সঙ্গে সঙ্গে চলল। দেখলাম, সেটার কোথাও আঘাত লাগেনি। যদিও আমার
অবস্থা খুবই কাহিল। কুকুর দুটোর কাছাকাছি হবার আগেই মাটিতে পড়ে গেলাম। ধুলো আর
রক্তে সারা শরীর মাখামাখি।
আমার
জীবন তখন চিতাটার দয়ার ওপর নির্ভর। কেননা সে ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে যে, আমার
বাঘা দুটো বাঁধা। অতএব তাদের না ডরালেও চলে। বেড়ার যে কোনো ফাক দিয়েই সে ঢুকতে
পারে তখন।
ঠিক
এই সময় দূর থেকে আমার বিক্রি করা ছাগলটার ডাক শোনা গেল। সন্ধ্যা থেকে কোনো রকম
ডাকাডাকি না করে, সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল। কিন্তু তার
এতদিনকার সঙ্গীসাথীদের সভয় চিৎকার কানে যেতেই টনক নড়ে। ডাকাডাকি শুরু করে দেয় সরবে।
থমকে
দাঁড়াল চিতাটা। আমাকে ছেড়ে দিয়ে সে চলে গেল ছাগলটার খোজে। সমস্ত ব্যাপারটা এবার
বেশ সহজেই ঘটে গেল। ছোকরা শিকারি তৈরিই ছিল। চিতাটা মাচার কাছাকাছি হতেই, সে
তার কাম্য কাজটা করে দিল অনায়াসে।
ভীষণ
খুশি সে। কেননা ওটাই ছিল তার জীবনের প্রথম শিকার। ভোর হতেই সে চলে এল। আমাকে অমন বিশ্রী অবস্থায় দেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
চিকিৎসার বন্দোবস্ত করল। উপহার হিসেবে আমার ছাগলটাকে আমায় ফিরিয়ে দিল। পরে অবশ্য
ঘা-টা ভালো হলো, কিন্তু একটা দাগ চিরকালের মতোই রয়ে গেল শরীরে। এই দেখুন,
সেই দাগটা।
কিন্তু
না, আর নয়। কিছু মনে করবেন না, আমি এবার চলি। অনেক গল্প
হলো।
মূলঃ
Norah Burke
অনুবাদকঃ
সুকুমার ভট্টাচার্য
এডিটঃ
মারুফ আল মাহমুদ
No comments:
Post a Comment