![]() |
রম্য গল্প - অলৌকিক চাকতি রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ - Funny Story – Oloukik Chakti Rahassya |
রম্য
গল্প - অলৌকিক চাকতি রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ -
Funny Story – Oloukik Chakti Rahassya
আমার
ভাগনে ডন সেদিন ঘরে ঢুকে চাপা গলায় বলল, “মামা! মামা!
আলাদিন।”
“আলাদিন মানে?” অবাক
হয়ে তাকালুম ওর দিকে। ডনের চোখেমুখে
রহস্য ঝিলিক দিচ্ছে। হেঁটের কোনায়
কেমন একটা হাসি। একটু একটু হাঁফাচ্ছে। মনে হল, খুব দৌড়ে এসেছে শ্রীমান।
ডন
বলল, “আলাদিন মানে
ম্যাজিক ল্যাম্প। পেয়ে গেছি
মামা।”।
হাসতে
হাসতে বললুম, “বেশ তো, এবার ওটা ঘষে দ্যাখ,
দত্যি দানব বেরোয় নাকি।”
ডন
হাতের মুঠো খুলে আমার দিকে হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “জিনিসটা দেখতে
পাচ্ছ?”
ওর
হাতের চেটোয় একটা ছোট্ট চাকতি। আগে যেমন তামার
পয়সা ছিল, তেমনি। দেখতে। শ্যাওলা রঙের জং ধরে আছে। দেখে নিয়ে বললুম, “হ্যা রে, তবে
যে বললি আলাদিনের ম্যাজিক ল্যাম্প! এ তো দেখছি একটা চাকতি!
এটা ঘষে কি দৈত্যি বেরোবে? বড়জোর কষ্টেসিষ্টে
একটি টিকটিকি বেরুতে পারে।”
ডন
গম্ভীর হয়ে বলল, “না মামা। এটা আলাদিনের নাম্বার টু। এর ম্যাজিক একেবারে অন্যরকম।”
“কীরকম, শুনি?”
ডন
ঝটপট এপাশে-ওপাশে তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “খুব সিক্রেট
ব্যাপার,
মামা। তুমি আর আমি
ছাড়া কেউ যেন না জানতে পারে। এই চাকতিটা
যদি ভালুককে খাইয়ে দাও, ভালুকটা গাধা হয়ে যাবে। আবার গাধাকে খাইয়ে দিলে গাধাটা ভালুক হয়ে যাবে। দারুণ ম্যাজিক, তাই না?”
মুখটা
ওর মতো গম্ভীর করে বললুম, “তাই বুঝি? তুই
নিশ্চয় পরীক্ষা করে দেখেছিস?”
ডন
আনমনে বলল, “এখনও দেখিনি। সেজন্যেই তো তোমার কাছে এলুম। একা টেস্ট করতে সাহস পাচ্ছি না, মামা।”
ওকে
সাহস দিয়ে বললুম, “ভাবিস নে। আমি তোর সঙ্গে আছি। তবে তার আগে
গোড়ার কথাটা বল তো বাবা, এ চাকতি তুই পেলি কোথায়? আর এটার এমন ম্যাজিকের কথাই বা, জানলি কীভাবে?”
ডন
এতক্ষণে শান্ত হয়ে বসল। তারপর চাকতি-রহস্য
ফাঁস করল। চাকতিটা তাকে
দিয়েছে বুধিরাম ভালুকওয়ালা। বুধিরামকে আমি
কখনও দেখিনি। তার ভালুকটাও
দেখিনি। তবে এই ছোট্ট শহরে মাঝে মাঝে ভালুকওয়ালা
ডুগডুগি বাজাতে-বাজাতে ভালুকের খেলা দেখাতে আসে। কুকুরগুলো তাতে বেজায় রেগে যায়। ভালুকওয়ালা পাড়া ছেড়ে গেলেও পাড়ার কুকুরদের রাগ কতক্ষণ পড়ে
না। তাদের গজরানি শুনে টের পাই,
--ভালুকের নাচের আসর বসেছিল পাড়ায়।
তো
বুধিরাম ডনকে দু’টাকায় চাকতিটা বেচে গেছে। এই অলৌকিক চাকতি বুধিরাম পেয়েছিল হরিদ্বারে এক সাধুর কাছে। ঝড়-বৃষ্টির রাতে বনের ভেতর ভালুকের বাচ্চা ধরতে গিয়ে
বিপদে পড়েছিল বুধিরাম। অনেক কষ্টে
একটা পাহাড়ি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে ছিলেন
সেই সাধু। কিন্তু তিনি
অসুস্থ। বুধিরাম তার সেবাযত্ন করেছিল। তবু বাঁচাতে পারেনি। মৃত্যুর আগে
সাধুবাবা তাকে চাকতিটা দিয়েছিলেন।
বুধিরাম
চাকতিটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। বাচ্চা ভালুকটাকে
নাচ আর হরেকরকম খেলা শিখিয়ে বড় করেছিল। এর পর একদিন
নদীর ধারে শীতের রোদে বসে বুধিরাম ছাতু খাচ্ছে। তার ভালুকটা পাশে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। হঠাৎ হল কি, ভালুকটা বুধিরামের ঝোলার কোণটা চিবুতে শুরু
করল। প্রথমে বুধিরাম
অতটা লক্ষ করেনি। তারপর দেখল, ভালুকটা
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। সটান দুপায়ে
ভর করে দাঁড়িয়ে আচমকা অবিকল গাধার মতো একখানা ডাক ছাড়ল। বুধিরাম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। দেখতে-দেখতে ভালুকের কালো চেহারা সাদা হয়ে যাচ্ছে। গড়নও বদলাচ্ছে। তারপর ফের একবার
ডাক ছাড়তেই তাজ্জব বুধিরাম দেখল, তার সাধের ভালুক স্রেফ গাধা হয়ে গেছে এবং
গলায় বকলেস ও শেকল সমেত চার ঠ্যাঙে নড়বড় করতে-করতে এগিয়ে
চলেছে। ছাতু খাওয়া
ফেলে বুধিরাম চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ল। “আরে উল্লুক। করছিস কী! তুই গাধা নাকি? তুই
তো ভাল্লুক আছিস।”
ভালুক
বা গাধা- যাই হোক, সে কানে নিল না। ঝোপ-ঝাড়
পেরিয়ে ওপাশের মাঠে গিয়ে পড়ল। এতক্ষণে বুধিরাম
টের পেল কী হয়েছে। ওর ঝুলির তলার
নানান টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে সাধুবাবার চাকতিটাও রেখে দিয়েছিল। হাঁদারাম ভালুক ঝুলির কোণসুদ্ধ চাকতিটা গিলে ফেলেই এক গণ্ডগোল।।
বুধিরামের
তখন মহা সমস্যা। শিক্ষিত ভালুক
হাতছাড়া হলে রোজগার বন্ধ। সে দৌড়ল। মাঠে গিয়ে দেখল, তার নির্বোধ জানোয়ারটা গিয়ে
পড়েছে এক ধোপার পাল্লায়। ধোপার নাম হাসু। হাসু ঝিলের ধারে কাপড় কেচে শুকাতে দিয়েছিল। সবে জড়ো করে প্রকাণ্ড বোচকা বেঁধেছে, এমন
সময় গাধাটা পেয়ে তার সুবিধেই হল।
আসলে
হয়েছে কি, হাসুর একটা গাধা ছিল। গাধাটা কদিন আগে হারিয়ে গেছে। এই গাধাটা দেখে হাসু ভেবেছে, তারই সেই হারানো গাধার
সুবুদ্ধি হয়েছে এবং মনিবের কাছে ফিরে এসেছে। গলায় বকলেস আর শেকল দেখে হাসু দুঃখ করে বলল, “আহা! কোন
বদমাশের পাল্লায় পড়েছিলি বাবা? দেখ দিকি, গলায় বকলেস আর শেকল পরিয়ে বেঁধে রেখেছিল! চল,
চল। বাড়ি গিয়ে
খুলে দেব।” বোকা
জানোয়ারটা দিব্যি হাসুর প্রকাণ্ড বোঁচকা পিঠে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, এতটুকু আপত্তি করছে না দেখে বুধিরামের চোখে জল এসে গেল রাগে আর দুঃখে। মনে মনে বলল, “তবে রে নেমকহারাম! তারপর
সোজা এগিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, “অ্যাই বেটাচ্ছেলে! তুই
গাধা, না ভালুক? ফেলে দে বোঁচকা। ফেলে দে বলছি।”
ব্যস, হাসুর
সঙ্গে বুধিরামের ঝগড়া বেধে গেল। হাসু বলে, “এ আমার গাধা!” বুধিরাম
বলে, “কক্ষনো না, এ আমার ভালুক!” গণ্ডগোল
শুনে ভিড় জমে গেল। ঝগড়াঝাটিতে
ভিড় জমলে যা হয়, একদল হাসুর পক্ষে, আরেকদল
বুধিরামের পক্ষে। তার ফলে মারামারি
বেধে যায় আর কি! খবর পেয়ে থানা থেকে দারোগাবাবু এক দঙ্গল সেপাই
নিয়ে হাজির। দারোগাবাবু
সব শুনে এক কথায় মীমাসা করে দিলেন। “বেশ! সাধুর
খেয়েই যদি বুধিরামের ভালুক হাসুর গাধা হয়ে থাকে, তা হলে চাকতিটা
ওর পেটেই আছে। পেট চিরে দেখলেই
বোঝা যাবে।”
এতে
কিন্তু হাসুর যত, তত বুধিরামেরও আপত্তি জানোয়ারটা মারা পড়বে যে!
শেষে হাসুই একটা ফিকির বাতলে দিল। গাধার লাদি হাতড়ে দেখবে, চাকতি আছে নাকি থাকলে আলবাত
যার জানোয়ার তাকে ফেরত দেবে। বুধিরাম অগত্যা
রাজি হল।
সাধুর
চাকতি যাবে কোথায়? পরদিনই গাধার আস্তাবলে পাওয়া গেল। তখন হাসু বুধিরামকে বলল, “ভাই বুধিরাম! গাধাটা
দিলে আমি কষ্টে পড়ব। তার চেয়ে বরং
তুমি কিছু টাকা নাও। ভালুক তো তুমি
জঙ্গলে খুজলে পেয়ে যাবে বিনি পয়সায়। গাধা তো বিনি পয়সায় জঙ্গলে পাব
না।”
বুধিরাম
ভেবে দেখল, মন্দ হবে না। সে টাকা নিয়ে চলে এল। হাসু-ধোপর
বাড়িতে সেই আজগুবি ভালুক বা গাধা, কিংবা গাধা বা ভালুক যাই হোক,
বহাল তবিয়তে আছে। কাপড়ের বোঁচকা
বইছে। মন ভাল থাকলে গানও গাইছে গলা ছেড়ে। বুধিরাম ফের একটা ভালুক যোগাড় করেছে জঙ্গল ছুঁড়ে। তবে এখনও পোষ মানেনি তত। মাঝে মাঝে পালিয়ে যায়। খুঁজে নিয়ে আসে বুধিরাম।
অলৌকিক
চাকতির গুপ্তরহস্য ফাঁস করে শ্রীমান ডন বলল, “চাকতিটা পেয়ে একটা
কথা ভাবছি, মামা। যা খেয়ে ভালুক
গাধা হয়ে যায়, তা খেয়ে গাধাই বা ভালুক হবে না কেন?”
সায়
দিয়ে বললুম, “ঠিক বলেছ। তাই তো হওয়া উচিত।”
ডন
ফিসফিস করে বলল, “কাকেও বোলো না মামা। রোজ বিকেলে দেখি, ঝিলের ধারে ধোপাদের গাধা চরে
বেড়ায়। খাইয়ে দেব
চাকতিটা। কিন্তু একা
যে পারব না। তোমার সাহায্য
চাই মামা!”
মনে
মনে আঁতকে উঠে বললাম, “বেশ তো। আগে তুমি একা চেষ্টা করে দেখ। না পারলে আমি তো আছি!”
ডন
উৎসাহে প্রায় নাচতে-নাচতে বেরিয়ে গেল। বুঝলাম, বেচারা গাধাদের বরাতে কিংবা উলটো ডনের ভাগ্যেই
কিছু একটা আছে। গাধাকে চাকতি
গেলানো কি সহজ কথা? বিকেলে দূর থেকে দেখলাম, শ্রীমান ডন মাঠে ওৎ পেতে আছে। একটা গাধা আনমনে চরছে। একটু পরে ডন
কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হু, বুদ্ধি
আছে শ্রীমানের। একগোছা ঘাসের
ভেতর চাকতিটা গুজে গাধাটার মুখের সামনে ধরল। অবাক হয়ে দেখলাম, গাধাটা
ঘাসের গোছা মুখে পুরে দিল। এবার আমার গা
শিউরে উঠল। সত্যিই কি কিছু
ঘটবে?
সেকেগু গুলো লম্বা মনে হচ্ছিল। মিনিটগুলো কাটতে চায় না। গাধাটা আকাশের দিকে আচমকা একটা বাজখাই হাঁক ছাড়ল। তারপর ওপাশের জঙ্গলের দিকে দৌড়ল। চোখে কি ভুল দেখছি, গাধাটার গায়ের রঙ যেন বদলে
ধূসর হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য সূর্য
ডুবে গেছে। রোদ আর নেই। ছাইরঙা আলোয় গাধার গায়ের রং ধূসর দেখানোও স্বাভাবিক। তাতে বেশ খানিকটা দূরে আছি। ডনকে দেখলাম। পা টিপেটিপে
জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল। তারপর আর কাউকেও
দেখতে পেলুম না। না গাধা, না
ডন।
মিনিট
পাঁচেক পরে হঠাৎ ডন প্রায় ডিগবাজি খেয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল এবং দিশেহারা হয়ে
দৌড়তে থাকল। চেঁচিয়ে ডাকলাম, “ডন! ডন!
কী হয়েছে?”
আমাকে
দেখে ডন দৌড়ে কাছে এল। হাঁফাতে হাঁফাতে
বলল, “গাধা মামা, গাধা!
ভালুক হয়ে গেছে!”
শিউরে
উঠে বললাম, “বলিস কী! চল তো দেখি!”
ঝিলের
ধারে জঙ্গলটার ভেতর কতকালের একটা ভাঙা মন্দির আছে। তখনও আলো মরেনি। ডনের ইশারা-মতো
উঁকি মেরে দেখি, মন্দিরের চত্বরে সত্যি একটা কালো ভালুক সামনের
দু ঠ্যাঙ খাড়া করে বসে আছে। কী হিংস্র চেহারা!
তা
তো হবেই। ‘চাকতির ম্যাজিক’ ফিসফিস করে
বললাম,
“এখন আর কিছু
করার নেই। কাল সকালে বরং
ভালুকটার একটা ব্যবস্থা করা যাবে। হিড়িক ফেলে
দেব আমরা। পৃথিবী জুড়ে
হইচই পড়ে যাবে দেখবি।”
ডন
খুশি হয়ে বলল, “আমরা নোবেল প্রাইজ পেয়ে যাব, কী
বলো মামা?”
“তা আর বলতে?” বলে
আমরা মাঠে ফিরে এলাম। সেই সময় দেখি
হাতে একটা ছড়ি নিয়ে ব্যস্তভাবে একটা লোক আসছে। তার কাঁধে ঝুলি। অন্য হাতে একটা
ডুগডুগি। আমরা দাড়িয়ে
গেলাম।
লোকটা
সালাম দিয়ে বলল, “বাবুজি! এদিকে
একটা ভালুক দেখেছেন? আমার ভালুকটা পালিয়ে এসেছে। খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
ডন
প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “বুধিরাম, বুধিরাম!
ওখানে একটা ভালুক আছে কিন্তু। খবর্দার, ওটা তোমার ভালুকটা ভেবে বোসো না বলে দিচ্ছি।”
“জরুর” বলে
মুচকি হেসে বুধিরাম দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকল। আমি গম্ভীর হয়ে ডনের হাত ধরে বললাম, “বাড়ি আয় ডন!” এই সময়
আবছা আঁধারে কোথাও একটা গাধা ডেকে উঠল। সাধুর চাকতি গলায় আটকে যায়নি তো গাধাটার? ডনটা
বড় বাজে ঝামেলা করে।
No comments:
Post a Comment