![]() |
দ্যা মিলিওন পাউন্ড ব্যাংক নোট – মার্ক টোয়েন – TheMillion Pound Bank Note – Mark Twain - Bangla |
দ্যা মিলিওন পাউন্ড ব্যাংক নোট – মার্ক টোয়েন – The Million Pound Bank Note – Mark Twain - Bangla (Part 3 of 3)
আমাদের
সময়টা বেশ কাটল। অন্তত আমার এবং মিস ল্যাংহামের তো বটেই! আমি
এতই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে, অকপটে তার কাছে আমার সব কথা খুলে
বললাম। আমি তাকে বললাম, আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কথাটা শোনামাত্র
সে আরক্তিম হয়ে উঠল, যেন তার চুলও লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু কথাটা তার মনে ধরেছে। সে বলল যে সে আমাকে পছন্দ করেছে।
আহ! এমনি একটা স্নিগ্ধ মনোরম সন্ধে আর কখনও আসেনি আমার জীবনে।
তার
সঙ্গে আমি পুরোপুরি সহৃদয় ও অকৃত্রিম ভাব বজায় রেখেছিলাম। তাকে জানালাম যে দশলক্ষ
পাউন্ডের নোটের এত গল্প সে শুনেছে, সেটা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার
আর একটা সেন্টও নেই। আবার সেই নোটটাও আমার নয়। কথাটা তার কৌতুহলের উদ্রেক করল। তারপর
নিচু গলায় তাকে গোড়া থেকে সমস্ত গল্পটাই বলে ফেললাম। শুনে হাসতে হাসতে তার দম আটকাবার উপক্রম হল। এমন অট্টহাসি হাসবার
মতো কী এমন দেখল সে, আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। কিন্তু কারণ নিশ্চয়ই
কিছু একটা আছে। প্রতি আধ-মিনিটে একটা নতুন ঘটনার উল্লেখ হতে লাগল। আর তার জন্য তাকে দেড় মিনিট সময় দিতে হত তার বেসামাল হাসি থামাতে।
হাসতে হাসতে নিজেকে সে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছে। সত্যি, হাসির আবেগে সে একেবারে নিঃসাড় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এমন কিছু ঘটার মতো কিছুই তো আমি দেখলাম না। কোনো একটা লোকের
জীবনের বেদনাময় ঘটনা, তার কষ্ট, উৎকণ্ঠা ও ভয়ের
কাহিনী যে কারও এমনি অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে, এর আগে তা কখনও
দেখিনি। সুতরাং বিনা কারণেও যে সে এত উৎফুল্ল হতে পারে, তার জন্য
তাকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেললাম। কারণ, ঘটনা যেভাবে এগিয়ে চলছে
তাতে আমার এই-জাতীয় একটা স্ত্রীর প্রয়োজন ছিল। অবশ্য আমি তাকে
বলেছিলাম, দু’বছর আমরা বেতনের টাকা
ভোগ করতে পারব না। সে বছর-দুটো আমাদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে। তাতেও তার
কোনো আপত্তি ছিল না। শুধু সে আমাকে সাবধান করে দিল, তৃতীয় বছরের
বেতনের ওপর যাতে হাত না পড়ে আমি যেন সেভাবে হিসাব ধরে চলি। তারপর এই ভেবে সে উৎকণ্ঠা
প্রকাশ করল, সত্যিকারভাবে প্রথম বছরের যে বেতনটা পাওয়া যাবে
তার চেয়ে বেশি হিসাব ধরা একটা ভুল হয়ে যায় নি তো? আমার মনে হল,
সত্যি, এটা একটা চিন্তার বিষয় এবং একথা ভাবতে
গিয়ে আগের চেয়ে এ ব্যাপারে আমার আস্থা অনেকটা কমে গেল। কিন্তু চিন্তাটা আমার মধ্যে একটা ব্যবসায়ী বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিল।
‘পোর্শিয়া,
যদি কিছু মনে না কর, সেই বুড়ো ভদ্রলোকদের সামনে যেদিন আমি যাব, সেদিন
কি তোমায় সঙ্গে নিতে পারব?’
সে
একটু কুণ্ঠিত হয়ে পড়ল। কিন্তু বলল, ‘এতে যদি তোমার
সাহায্য হয়, তবে অবশ্যই আমি যাব। তুমি কি মনে কর, সেটা ঠিক হবে?’
‘আমি ঠিক বলতে
পারি না,
ঠিক হবে কিনা। আমার ভয় হয়, হয়তো-বা ঠিক হবে না। কিন্তু এর ওপর
আমি এত আশা করে আছি যে—’
‘তাহলে ভালো
হোক আর মন্দ হোক, আমি অবশ্যই যাব তোমার সাথে। স্নিগ্ধ মাধুর্যভরা
একঝলক উদ্দীপনার সঙ্গে সে কথাগুলো বলল।’
“আহ, আমি
যে তোমাকে সাহায্য করছি, এ-কথা ভেবে আমার
যে কী আনন্দ!’
‘সাহায্য, তোমাকেই
সবকিছু করতে হবে। তুমি এত সুন্দরী, মনোরমা
ও মনোহারিণী যে, তুমি সঙ্গে থাকলে আমি মাইনের ব্যাপারে বুড়ো দু-জনকে তাদের সর্বোচ্চ হারে রাজি করাতে পারব এবং কিছুতেই তারা তা এড়াতে পারবেন
না।’
তার
ধমনীর রক্ত বোধ হয় চঞ্চল হয়ে উঠল এবং তার অনুপম চোখ দুটি থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগল,
‘তুমি একটা দুষ্ট
চাটুকার!
তোমার কথায় এক বিন্দুও সত্য নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি তোমার সঙ্গে
যাব এবং তোমাকে এ-শিক্ষা দিতে চাই যে, অন্য
লোক তোমার চোখ দিয়ে দেখুক—এটা তুমি আশা করতে পার না।’
আমার
সন্দেহ কি দূর হল? আমার আস্থা কি ফিরে এল! এ থেকে সেটা বিচার করা যেতে পারে : গোপনে গোপনে আমার
প্রথম বছরের বেতন বারশ পাউন্ড তুলেছিলাম! কিন্তু তাকে কিছু বলিনি। সেটা সে করে দিতে পারবে আশা করে রয়েছি। বাড়ি ফেরার সময় সারাটা
পথ আমি একটা অন্ধকারের মধ্যে ছিলাম। হেস্টিংস বকে
যাচ্ছিল,
আমি তার একবিন্দু শুনছিলাম না। যখন আমরা দুজন আমার বৈঠকখানায় ঢুকছিলাম তখন আমার
স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌখিনতা সম্পর্কে হেস্টিংস-এর উচছুসিত প্রশংসায় আমি নিজের মধ্যে
ফিরে এলাম।
‘রোস, আমি
এখানে দাড়িয়ে একটু প্রাণ ভরে দেখে নিই। আহ, এটা একটা প্রাসাদ, একেবারে
পুরোপুরি প্রাসাদ। এখানে যে-কোনো লোক কয়লার আগুন এবং নৈশ-আহার থেকে শুরু করে যে-কোনো জিনিস আশা করতে পারে। হেনরি, শুধু আমাকে একথাই বলে দিচ্ছে না যে, তুমি কত ধনী—আমাকে আরও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং আমি হাড়ে
হাড়ে বুঝতে পারছি যে আমি কত গরিব, কত নিঃস্ব, কত পরাস্ত এবং সর্বস্বান্ত!
‘সব গোল্লায়
যাক!’
তার
কথায় আমি চমকে উঠলাম। আমি ভয় পেয়ে
গেলাম। তার কথায় আমি বুঝতে পারলাম আমার পায়ের
তলায় রয়েছে একটা জ্বলন্ত অগ্নিগিরি এবং আমি তার উপরের আধ ইঞ্চি পুরু আবরণের উপর দাঁড়িয়ে
আছি। আমি বুঝতে পারিনি যে, আমি স্বপ্ন দেখছি কি না। কিন্তু এটা ঠিক, নিজেকে আমি আসল ব্যাপারটা বোঝাবার
এতটুকুও চেষ্টা করিনি। কিন্তু এখন, আগাগোড়া আমি দেনায় ডুবে আছি—আমার হাতে একটা
পয়সাও নেই। একটা সুন্দরী মেয়ের সুখ-শান্তির ভার আমার ওপর!
আমার সামনে কিছুই নেই—শুধু একটা মোটা বেতনের
আশা। তা-ও আবার পূর্ণ না-ও হতে পারে। আমার মনে হল, আমি যেন একেবারে ধ্বংস হয়ে
গেছি। তার থেকে বাবার কোনো ভরসা আমার নেই।
‘হেনরি, তোমাকে
দৈনিক আয়ের সামান্যতম একটু হলেও—’
‘হায়, আমার
দৈনিক আয়! নাও, এই ভালো, স্কচ খেয়ে নাও এবং মনকে উৎফুল্ল কর। এই নাও। অথবা—’
‘ও, না থাক, তুমিও ক্ষুধার্ত। বস এবং —’
‘আমার কিছুর
দরকার নেই। আমি আজকাল খেতে পারি না। তবে আমি তোমার সঙ্গে খাব, যতক্ষণ-না আমি পড়ে যাই। এস!’
‘ব্যারেল, ব্যারেল
খাও? তোমাকে আমি তাই দেব। জিনও?’
‘হ্যা, লয়েড,
আমি পেয়ালায় ঢালছি। তুমি তোমার
গল্প শুরু কর।’
‘আবার কী গল্প?’
‘আবার? কী বলছ?’
‘হ্যা, আমি
বলছি যে, তুমি কি সেটা আবার শুনতে চাইছ?’
‘আমি কি আবার
শুনতে চাচ্ছি? এটা একটা ধাঁধা। রাখ, আর ওগুলো খেয়ে না। তোমার আর দরকার নেই।’
‘শোন হেনরি, তুমি
আমাকে সত্যি ভয় পাইয়ে দিয়েছ। আসতে আসতে তোমাকে গল্পটা বলিনি?’
‘তুমি’
‘হ্যা, আমি।’
‘আমি যদি কিছু
শুনে থাকি, তবে আমার ফাসি হোক।’
‘হেনরি, এটা
খুব খারাপ কথা। আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। রাষ্ট্রদূতের ওখানে থাকতে তোমার কী হয়েছিল,
বল তো?’
আবার
সবকিছু আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি নিজেকে
ফিরে পেলাম।
‘আমি পৃথিবীর
সেরা মেয়েকে পেয়েছি—তাকে বন্দি করেছি।’
তক্ষুনি
সে ছুটে এল এবং আমরা দুজনে বারবার করমর্দন করতে লাগলাম।
আমি
এত বেশি করে করমর্দন করলাম যে, হাতে ব্যথা ধরে গেল এবং তিন মাইল আসতে আসতে
সে যে গল্প বলেছে, তার এক বিন্দুও না-শোনাতে
সে কোনো অনুযোগ করল না। সে বসে পড়ল এবং ধৈর্যশীল লোকের মতো সমস্ত গল্পটা আবার আমাকে
শোনাল। সংক্ষেপে তার কথাগুলো হচ্ছে এই : একটা বড় রকমের সুযোগ
পেয়ে সে ইংল্যান্ড এসেছিল। পাউন্ড ও মুদ্রা এক্সটেনশন লেন-দেনের
সে সুযোগ পেয়েছিল। দশলক্ষ ডলারের ওপর যা লেনদেন হবে, তা হবে তার
নিজস্ব। সে যথেষ্ট পরিশ্রম
করেছে,
প্রতিটি পন্থাতেই চেষ্টা করেছে—কোনো চেষ্টারই
সে কসুর করেনি এবং তার যত টাকা ছিল, তার প্রায় সবই সে এতে ব্যয়
করে ফেলেছে। তার কথা শোনার
মতো একজন মহাজনও সে পায়নি। আর একমাসের ভেতরই তার চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। এক কথায়
সে সর্বস্বান্ত হয়েছে। কথাগুলো শেষ
হওয়ার পরই সে লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে বলল :
‘হেনরি, তুমি
আমাকে সাহায্য করতে পার, তাহলে আমি রক্ষা পাব। তুমি কি তা করবে? বল, তুমি কি আমায় সাহায্য
করবে?’
‘কী করে? খুলে
বল, কী করে তোমায় আমি বাচাতে পারি।’
‘আমাকে দশলক্ষ
ডলার এবং দেশে যাবার ভাড়া দাও ; অস্বীকার কর না, হেনরি।’
ওর
কথায় আমার বড় কষ্ট বোধ হল। প্রায় একে
বলেই ফেলেছিলাম—‘লয়েড, আমি নিজেই একজন ভিখেরি—কপর্কহীন, দেউলে
এবং দেনাগ্রস্ত। কিন্তু হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। মুখ চেপে রেখে নিজেকে
শান্ত করলাম এবং একজন পুঁজিওয়ালা মহাজনের মতো, ব্যবসায়ীর মতো
বললাম :
‘আমি তোমাকে
সাহায্য করব, লয়েড়—’
‘আহা, আমায়
বাঁচালে হেনরি। তাহলে আমি সত্যিই রক্ষা
পেয়ে গেছি। ঈশ্বর তোমার
মঙ্গল করুন। হেনরি যদি কখনও—’
‘আমাকে শেষ
করতে দাও,
লয়েড। আমি তোমাকে
সাহায্য করব, তবে ঠিক এভাবে নয়। তোমার এত কষ্ট স্বীকার এবং ঝুঁকি নেবার
পর সেটা তোমার পক্ষে মঙ্গলকর হবে না। খনি কেনার আমার
প্রয়োজন নেই। তা ছাড়াও লন্ডনের মতো ব্যবসাকেন্দ্রে আমার মূলধন খাটানোর অসুবিধে হবে
না। সেটাই আমি সবসময় চেয়েছি। আমি যা করব তা হচ্ছে—এই খনিটার ব্যাপারে
আমার সব জানা আছে—এর অপরিমিত সম্পদের কথাও আমার জানা রয়েছে এবং
তা আমি যে-কোনো লোকের কাছে হলফ করে বলতে পারি। তুমি আমার নাম ভাঙিয়ে খনির
ভেতরের অংশটা নগদ ৩০ লক্ষ ডলারে বিক্রি করে ফেলতে পারবে। তারপর সমান অংশে আমরা সে টাকা ভাগ করে নেব।’
বিশ্বাস
করবেন না,
ও পাগলের মতো নাচতে লাগল। আমি ধরে না ফেললে আসবাবপত্রের উপর পড়ে সে
সব ভেঙে-চুরে ফেলত।
এরপর
নিশ্চিন্ত আরামে সে সেখানে শরীর এলিয়ে দিল এবং শান্ত কণ্ঠে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললঃ
‘তোমার নাম আমি
ব্যবহার করতে পারি। তোমার নাম—চিন্তা করে দেখ! আহ
কী ভাগ্য! লন্ডনের সব বড় বড় ধনী যে আমাকে ছেকে ধরবে খনির ভেতরের
সব জিনিসের জন্যে। আমি বড়লোক হয়ে গেছি! আমি যতদিন বেঁচে থাকব,
তোমাকে কিছুতেই ভুলতে পারব না, হেনরি!’
চব্বিশ
ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে গোটা লণ্ডন শহর এই খবরে মুখর হয়ে উঠল, আমাকে
কিছুই করতে হয়নি। দিনের পর দিন আমি ঘরে বসে থেকেছি এবং লোককে বলেছি : ‘হ্যা, আমি
তাকে বলেছি, আমার কথা বলতে। লোকটাকে আমি চিনি, খনিটাও চিনি! তার চরিত্র সব সন্দেহের উর্ধ্বে। আর খনির জন্যে যে দাম সে চাচ্ছে, তার
চেয়ে তার সত্যিকারের মূল্য আরও অনেক বেশি।’
ইতিমধ্যে
আমি আমার মনোরম সন্ধ্যা গুলো রাষ্ট্রদূতের ভবনে কাটিয়েছি। আমি পোর্শিয়াকে খনি সম্বন্ধে
একটা কথাও বলিনি।
রাষ্ট্রদূতের
পত্নী ও কন্যা আমাদের (আমার ও পোর্শিয়ার বিয়ের ব্যাপার) ব্যাপারটিতে বেশ আগ্রহ দেখাতেন
এবং আমাদের নানা বাধা-বিপত্তি থেকে রক্ষা করার জন্যে নানা ফন্দি-ফিকির বের করতেন। আমাদের ব্যাপারে
রাষ্ট্রদূতকে নিঃসন্দেহ রাখার জন্য তার কাছে সব কথা তারা গোপন করতেন। সত্যি, তারা কত ভালো!
অবশেষে
মাস শেষ হলে লন্ডন ও কাউন্টি ব্যাঙ্কে আমার নামে দশলক্ষ ডলার জমা হল। হেস্টিংসের নামেও জমা হল দশলক্ষ ডলার। যথাসাধ্য ভালো পোশাকে সজ্জিত
হয়ে পোর্টল্যান্ড প্লেসে মালিকের বাড়ির পাশ দিয়ে গাড়ি করে গেলাম। অবস্থা দেখে মনে হল, আমার শিকার ফিরে এসেছে। আমি রাষ্ট্রদূতের বাসায় গিয়ে আমার পোর্শিয়াকে সঙ্গে নিলাম এবং
মালিকের বাড়ির দিকে যেতে লাগলাম। পথে শুধু বেতনের কথাই বলতে লাগলাম। সে এতে উত্তেজিত এবং উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল যে, তাকে
অত্যন্ত সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি বললাম :
‘তোমাকে যেমনটা দেখাচ্ছে, তাতে
তিন হাজার পাউন্ডের এক পেনি কম চাওয়াও আমার অপরাধ হবে।’
‘হেনরি, হেনরি! তুমি আমাদের সর্বনাশ করবে।’
‘ভয় পেয়ো না।
তোমার চোখের মাধুর্য ঠিক রেখো এবং আমার ওপর বিশ্বাস রেখো। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
সুতরাং, সারা
পথ তার সাহস বাড়িয়ে তোলাই ছিল আমার কাজ। সে একসময় অনুনয় করে আমায় বলল :
‘মনে রেখো, আমরা
যদি খুব বেশি বেতনের জন্য পীড়াপীড়ি করি তাহলে বেতন একেবারে না-ও পেতে পারি। আর তাহলে জীবিকা উপার্জনের আর কোনো পথই খোলা থাকবে না!
সে অবস্থায় আমাদের কী উপায় হবে, বল?’
সেখানে
পৌছালে সেই পরিচারকটিই আমাদের পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। সেখানে বুড়ো ভদ্রলোক দুজন
বসেছিলেন। কিন্তু তারা
আমার সঙ্গে এই আশ্চর্য জীবটি, অর্থাৎ পোর্শিয়াকে সঙ্গে দেখে বিস্মিত হলেন।
আমি বললাম : ‘এতে অবাক হওয়ার কিছু
নেই। এ আমার হবু বউ।’
আমি
তাদের সঙ্গে পোর্শিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিলাম এবং তাঁদের নামও বললাম। তাদের নাম বলায়
তারা আশ্চর্য হননি। কারণ, এঁরা বুঝেছিলেন ডাইরেক্টরি থেকে নাম সংগ্রহ করার
মতো জ্ঞান আমার আছে। তারা আমাদের দুজনকে বসতে বললেন এবং আমাদের সঙ্গে খুব ভদ্র ব্যবহার
করতে লাগলেন। পোর্শিয়ার সঙ্গে এমন সৌজন্য দেখালেন যে, কিছুক্ষণের
মধ্যেই তার অপ্রস্তুত ভাবটা কেটে গেল এবং সে খুব সহজ হয়ে উঠল। এরপর আমি বললাম :
‘মহোদয়গণ, আমি
এখন আমার বিবরণ পেশ করতে চাই।’
‘আমরা শুনে খুশি
হলাম,
আমার মালিক বললেন। আমার ভাই অ্যাবেল
ও আমি যে বাজি রেখেছি, সেটা এখন নিশ্চয়ই স্থির করতে পারি। তুমি যদি
আমাকে জিতিয়ে থাক, তাহলে আমার দানপত্রের মধ্যে যে-কোনো একটা চাকরি তোমাকে দেব। তোমার কাছে সে দশলক্ষ পাউন্ডের নোটটা কি আছে?’
‘এই যে সেটা।’ —এই বলে নোটটা
আমি তার হাতে দিলাম।
‘আমি জিতেছি।
তিনি জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন এবং উত্তেজনায় অ্যাবেলের পিঠ চাপড়ে দিলেন।
‘দেখছি, সে
ঠিকভাবে—টিকে আছে এবং বাজিতে আমার হার হল! আমি
কুড়ি হাজার পাউন্ড হারলাম। আমি কখনও এটা
আশা করিনি এবং কখনও আমি এটা বিশ্বাস করতে পারতাম না।’
‘আমার আরও কিছু
বলবার আছে,’ আমি বললাম, সেটা
এক দীর্ঘ গল্প। পরে এসে আমি
সারা মাসে যা কিছু ঘটেছে, তা আপনাদের এক-এক করে শোনাব।
আমি আশ্বাস দিচ্ছি, সেটা শোনার মতোই হবে। এখন এটা দেখুন।
‘কী ব্যাপার! এখানে
দেখছি, দু'হাজার পাউন্ড জমা আছে। এটা কি
তোমার?’
‘হ্যা, আমার। ত্রিশ দিনের জন্যে আপনারা আমাকে যে ধার দিয়েছিলেন, তার
সদ্ব্যবহার করেই এটা করেছি। এ দিয়ে শুধু এইটুকু করেছি—কিছু জিনিসপত্র
কিনেছি এবং নোটটি তার পরিবর্তে দিতে চেয়েছি।’
‘এ তো খুব আশ্চর্যের
কথা! একেবারে অবিশ্বাস্য!’
‘কোনো ভাবনা
নেই। আমি এটা প্রমাণ করব। প্রমাণ ছাড়া
আমার কথা বিশ্বাস করবেন না।’
এবার
পোর্শিয়ার বিস্ময়ের পালা। বিস্ময়ে তার চোখ দুটো প্রসারিত হয়ে উঠল। আমার চোখের ওপর চোখ রেখে সে বলল : ‘হেনরি, সত্যিই এটা কি তোমার টাকা? তুমি কি আমার কাছে কথাটা গোপন করেছ?’
‘কিন্তু আমি
জানি পোর্শিয়া, তুমি
সেটা ক্ষমা করবে।’
ঠোট
কুঁচকে সে বলল : ‘অতটা নিশ্চিত হয়ো না। তুমি খুব দুষ্ট। তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়েছ।’
‘এ কিছুই না—এতে কিছু মনে
কর না। এতে কিছু মনে করার নেই—দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমার কাছে একটুখানি কৌতুক করেছি মাত্র। এবার চল, আমরা
যাই।’
‘অপেক্ষা কর। চাকরি? আমি তোমাকে একটা চাকরি দিতে চাই,’ আমার মালিক
বললেন।
‘সত্যি’! –আমি বললাম, ‘এতে আমি বিশেষ
কৃতার্থ হলাম। কিন্তু সত্যি
সত্যি আমি চাকরির দরকার নেই।’
‘কিন্তু, তুমি
আমার দানপত্র থেকে সবচেয়ে ভালো চাকরি বেছে নিতে পার।’
‘এজন্যেও আপনাকে
সর্বান্তকরণে ধন্যবাদ। কিন্তু আমি
তা-ও চাই না।’
‘হেনরি, আমি
তোমার জন্যে সত্যি লজ্জিত। বুড়ো ভদ্রলোককে যতটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, তার অর্ধেকও তুমি দিচ্ছ না। বল তো তোমার হয়ে আমি সেটা করি। নিশ্চয়ই, প্রিয়তমা! এর চাইতে
ভালো কিছু পারলে — তুমি চেষ্টা করে দেখতে
পার।’
পোর্শিয়া
চেয়ার ছেড়ে উঠে তখুনি আমার মালিকের কাছে এগিয়ে গেল। তার কোলের উপর বসল এবং বাহু দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো
খেল। তখন বুড়ো ভদ্রলোক দুজন উচ্চকণ্ঠে হেসে
উঠলেন। কিন্তু আমি একেবারে অবাক হয়ে গেছি। সোজা কথায়, আমি
একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। পোর্শিয়া বলল :
‘বাবা, সে
বলেছে, তোমার দানপত্রে এমন একটা চাকরিও নেই, যেটা সে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু আমি
মনে করি---’
‘প্রিয়তমা, উনি
কি তোমার বাবা?’
‘হ্যা, আমার
স্নেহময় বাবা এবং তিনিই আমার সবচেয়ে প্রিয়। তুমি এখন নিশ্চয়ই বুঝেছ, বাবা ও চাচার তৈরি সমস্যায়
পড়ে এবং আমাদের সম্বন্ধ না-জেনে রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে তুমি যখন
গল্প বলছিলে, তখন আমি কেন অত হেসেছিলাম।’
কাজেই
এখন আর বোকামি না করে সোজা কাজের কথায় এলাম।
‘হা স্যার, আমি
যা বলেছি, তা প্রত্যাহার করছি। আপনার কাছে একটিই চাকরি আছে এবং
সেটা আমি গ্রহণ করতে পারি।’
‘সে চাকরিটার
নাম বল।’
‘জামাই!'
‘বেশ, বেশ,
বেশ! কিন্তু তুমি ওই পদে কখনও চাকরি করে না থাকলে
চাকরির চুক্তি যথার্থভাবে পালন করবে এমনি আশ্বাস দিতে পারবে না। সুতরাং ----’
‘পরীক্ষা করে
দেখুন। আমি অনুরোধ করছি ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে পরীক্ষা করুন এবং যদি-’
‘ও, এটা
অতি সামান্য ব্যাপার। আচ্ছা, তুমি ওকে নিয়ে যাও।’
আমরা
সুখী হলাম। আমাদের এ আনন্দের
কথা বলার মতো ভাষা নেই আমার। দু-একদিন পরেই ব্যাঙ্কনোট-সংক্রান্ত আমার একমাসের সব ঘটনা এবং যেভাবে এ-কাহিনী
শেষ হয়েছে, তা লন্ডনের সবাই জানতে পেরে বেশ কৌতুক বোধ করল। আমার পোর্শিয়ার
বাবা সেই বন্ধুত্বের নিদর্শন-স্বরূপ নোটটি ব্যাঙ্কে নিয়ে ভাঙালেন। ব্যাঙ্ক সেটা বাতিল করে দিয়ে তাকেই উপহার দিল। তিনি নোটটা বিয়েতে
উপহার দিলেন এবং আমরা সেটা আয়নায় বাধাই করে আমাদের ঘরের সবচেয়ে ভালো জায়গায় চিরদিনের
জন্য টাঙিয়ে রাখলাম! কারণ, এর বদৌলতেই আমি আমার
পোর্শিয়াকে পেয়েছি। আর এটা না পেলে আমি লন্ডনে থাকতে পারতাম না, রাষ্ট্রদূতের বাসায় খেতে পারতাম না এবং পোর্শিয়ার সাথে কখনও আমার দেখা হত
না। তাই আমি সব সময় বলিঃ হ্যা, তোমরা দেখতে পাচ্ছ, এটা দশলক্ষ পাউন্ডের একখানি নোট। এটা দিয়ে একটা জিনিস কেনা হয়েছে—কিন্তু এটা
দিয়ে সে জিনিসটির দামের এক-দশমাংশমাত্র দেওয়া সম্ভব।
- - - - - - - - - - - শেষ - - - - - - - - - - -
No comments:
Post a Comment