![]() |
রহস্য গল্প - কঙ্ক - আলী ইমাম |
রহস্য গল্প - কঙ্ক - আলী ইমাম
বিন্নাঘাসের
ঝোপের পাশ দিয়ে সৎ করে চলে গেল জলডোরা সাপটা। ঝোপের ভেতরে থিকথিকে অন্ধকার। ভেজা মাটির
উপর সাপের ডিমগুলো চকচক করছে। উত্তরের নদীর দিক থেকে ছুটে আসছে ভয়ার্ত কঙ্ক। তার সমস্ত
শরীরে ঘামের স্রোত কুলকুল করে বইছে। একটি বন্য শূকর তাকে তাড়া করছে। কঙ্ক গিয়েছিল
পাহাড়ে এলাচ ফুল তুলতে। ওদের গ্রাম থেকে মশলা বোঝাই নৌকা যাবে সুবর্ণ দ্বীপে। গ্রামের
লোকজন তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে মশলা সংগ্রহ করছিল। সুবর্ণ দ্বীপে এবার বিরাট মেলা হবে।
সমতট,
হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ বরেন্দ্রের লোকজন আসবে।
এই
পাহাড়ের পাদদেশে জঙ্গলের ভেতরে হঠাৎ করে এলাচ গাছের সন্ধান পেয়েছিল কঙ্ক। খুব চাহিদা
এই সুগন্ধি দানাগুলোর। নগরীর অভিজাত লোকেরা এলাচ চূর্ণ মিশ্রিত পানীয় খেতে খুব পছন্দ
করে। সঙ্গে বুনো তিতির কিংবা ময়ুরের ঝলসানো মাংশ। শিকারিরা ফাঁদ পেতে এসব পাখি ধরে
এনে বিক্রি করে।
আকাশে
তখনও ফিকে অন্ধকার জমে রয়েছে। কঙ্ক নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে চলে এসেছে এলাচের জন্যে।
মরা শামুকের খোলে তার পা কেটে গেছে। গ্রামের অন্য লোকেরা এই গাছগুলোর
সন্ধান এখনও পায়নি।
কঙ্কের
মনে আনন্দ। সে যেন ভোরের ফুরফুরে বাতাসের ভেতরে পাখি হয়ে। উড়ে যাচ্ছে। ধনপতি
বণিক তাকে আশ্বাস দিয়েছে। প্রচুর এলাচ সংগ্রহ করতে পারলে তাকে এবার সুবর্ণ দ্বীপে
নিয়ে যাবে। কত দিনের শখ তার। দুরন্ত নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যাবে। মাথার উপর চক্কর
দেবে গাঙচিলের দল। অভিজ্ঞ নাবিকেরা তাকে বলবে দূরের রহস্যময় দ্বীপসমূহের কথা। যেখানে
শামুকের রঙের মতো বিশাল পাখি দেখা যায়। যে পাখিদের বাসায় হঠাৎ করে পাওয়া
যায় নীলকান্ত মণি।
মাথার
উপর লতাপাতার ঠাসবুনোট। জঙ্গলে কোনো শব্দ নেই। মাথা নিচু করে এলাচ তুলছিল কঙ্ক। হঠাৎ
ডালপালা ভাঙার শব্দ। চমকে তাকিয়ে দেখে দূরের ঝোপের ভেতরে একটি বন্য শূকর তার দিক তাকিয়ে
মাটি আঁচড়াচ্ছে। এক্ষুনি ছুটে আসবে। শূকর আগুনের ভাটার মতো লাল চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।
তাদের গ্রামের কয়েকজন নিহত হয়েছে বন্য শূকরের আক্রমণে। তাদের হেঁড়াখোড়া শবদেহ দেখে
আতঙ্কিত হয়েছিল সে।
কঙ্ক
এলাচ গুলো ফেলে ছুটতে লাগল। হিংস্র শূকর তাকে পেলে ফালা ফালা করে ছিড়ে ফেলবে।
কঙ্ক
বুদ্ধি করে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগল। পেছনে হিংস্র শূকর। নিরিবিলি জঙ্গলটা যেন
ঝনঝন করে উঠল। কয়েকটা কাঠবিড়ালি গাছের খোড়লে লুকিয়ে গেল। আর ছুটতে পারছে না কঙ্ক।
পা ভারী হয়ে আসছে। একটা গাছের বুনো লতায় হঠাৎ করে জড়িয়ে গেল। পেছন থেকে শূকরটা
তাকে আঘাত করল। পুরো পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল। কঙ্ক অনুভব করল তার পাঁজরের নিচে কেউ যেন
হাঁড় দিয়ে তৈরি একটি ছুরি আমূল বসিয়ে দিয়েছে। গলগল করে রক্তের স্রোত নামছে। মুখ
থুবড়ে মাটিতে পড়ল কঙ্ক। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার করে
শূকরটা পাশেই লুটিয়ে পড়ল। জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে কঙ্ক দেখল তীরবিদ্ধ হয়ে ছটফট
করছে শূকর। কে ছুড়ল এই তীর?
তীর
ছুড়েছিলো জীবক। এই অঞ্চলের একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক। শল্যচিকিৎসক হিশেবে তার খ্যাতি
বহু দেশে ছড়িয়ে গেছে। তাকে প্রায়ই জঙ্গলে আসতে হয় পশু সংগ্রহের জন্যে। বিভিন্ন
জানোয়ারের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে তিনি শরীরের ভেতরের স্নায়ুকোষের রহস্যকে আবিষ্কার করতে
চান। আজও তিনি এসেছিলেন এ রকমের পশু সংগ্রহের জন্যে। একটি ঢিবির উপরে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।
হঠাৎ দেখলেন একটি কিশোরকে তাড়া করছে বন্য শূকর। ছেলেটি মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। সঙ্গে
সঙ্গে তীর ছুড়ে তিনি শূকরটিকে হত্যা করলেন।
প্রচুর
রক্তপাত হচ্ছে ছেলেটির। সবুজ ঘাস লাল হয়ে গেছে। জীবক তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে তুলে নিলেন।
এক্ষুনি তার চিকিৎসার প্রয়োজন। তিনি ছুটতে লাগলেন। ছেলেটি ক্রমশ নেতিয়ে আসছে। জীবকের
খয়েরি পোশাক কঙ্কের রক্তে সপসপ করছে।
না, ছেলেটিকে
বোধহয় নগরী পর্যন্ত নেয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। জীবকের অভিজ্ঞ চোখ
বুঝে ফেলল ছেলেটির জীবনদীপ নিভে আসছে। তার চোখের সামনে একটি কিশোর এমন অসহায়ের মতো
মৃত্যুবরণ করবে? যে জীবকের শল্যচিকিৎসার প্রশংসা পুঁথিতে লিপিবদ্ধ হয়ে দেশে
বিদেশে ছড়িয়ে গেছে। তার হাতের উপর করুণভাবে মৃত্যু ঘটবে এই ছেলেটির? জীবক ছেলেটিকে একটি গাছের ছায়ায় শুইয়ে দিলেন। আকাশ তখন সোনালি রোদের ঢেউ
চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। জীবক তার পেটিকা থেকে একটি ছুরি বের করলেন। ছেলেটির কোমরের
কাছটা ক্ষতবিক্ষত ।
জীবক
খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। ঝিনঝিন করে ফড়িঙ উড়ছে। তার শল্যচিকিৎসার সরঞ্জাম রয়েছে
গৃহে। এই নির্জন অরণ্যে তিনি কীভাবে কিশোরটির প্রাণ রক্ষা করবেন? ঘামছেন
জীবক। তার বুকের ভেতরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
কিশোরটির
পাঁজরের কাছের রক্তনালীগুলো ছিড়ে গেছে। ছেলেটিকে বাঁচাতে হলে নতুন রক্তনালী সংযোজন
করতে হবে। মাথার উপর দিয়ে একটি শকুন উড়ে গেল। বনে হরিণের নরম মাংশের লোভে
থাবা তুলে ঘুরছে হলুদ ডোরাকাটা বাঘ। এখানে পায়ে পায়ে মৃত্যু। নীরব জঙ্গলে আতঙ্কের
ছায়া। নিহত শূকরটির উপর নিশ্চয়ই ঝাপিয়ে পড়বে। হঠাৎ কী মনে হওয়াতে চট করে উঠে দাঁড়ালেন
জীবক। ছুটে গেলেন তিনি নিহত শূকরের কাছে। তারপর নিপুণ হাতে ছুরি চালিয়ে চিরে ফেললেন
প্রাণীটিকে। ধূসর চামড়ার নিচে লাল মাংশ। ফুলের পাপড়ি যেমন করে উন্মোচিত হয় তেমনি
করে তিনি বরাহের শরীরের ভেতরের অংশ উন্মোচন করতে লাগলেন। অভিজ্ঞ চোখের সামনে তখন ফুটে
উঠল রক্তনালীর এক বিচিত্র জগত। এখনও উষ্ণতা রয়েছে প্রাণীটির দেহে। স্নায়ুতন্ত্রীগুলো
সজীবতা হারায়নি। জীবক নিপুণভাবে কেটে নিলেন কিছু জটিল গ্রন্থি। তার চোখ এখন শান্ত।
কিশোরের ছিড়ে যাওয়া গ্রন্থিগুলোতে তিনি এই বরাহের রক্তনালীর গ্রন্থি সংযোজন করবেন।
কিছু হলুদমণি মাথার উপর চক্কর দিয়ে উড়ছে। গাছের পাতা নড়ছে না। জীবক সমস্ত মন ঢেলে
সেই গাছের নিচে কঙ্কের আহত অংশের ছিন্ন হয়ে যাওয়া তন্ত্রীগুলোতে শূকরের তন্ত্রী সংযোজন
করতে লাগলেন।
জীবককে
দেখে এখন মনে হচ্ছে একজন কবির মতো। ভোরে কবিরা যেমন শুদ্ধ মন নিয়ে বাতায়নের পাশে
বসে ভূর্জপাতায় লিখতে থাকে মানুষের কল্যাণের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা তেমনি করে যেন
ঝুঁকে শ্রম দিচ্ছেন জীবক। তার সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবক এই ছিন্নতন্ত্রী জোড়া লাগাচ্ছেন।
শৈশবে তার পিতা তাকে কবি হতে বলেছিলেন। কবিরা মানুষের জন্য সুন্দর এবং কল্যাণময় পৃথিবীর
কথা বলেন। একটি তীরবিদ্ধ তিতির তাকে শল্যচিকিৎসক হতে অনুপ্রাণিত
করেছিল। তার চোখের সামনে তিতিরটি ছটফট করে মারা যায়। তিতিরের বুকের একটুখানি রক্ত
জীবকের হাতে লেগেছিল। বহু দিন পর্যন্ত রক্তের সেই গন্ধ পেয়েছেন জীবক। চন্দনচূর্ণ দিয়ে
ধৌত করেও সে গন্ধ দূর হয়নি।
মানুষের
শরীরের ভেতরের রহস্য আবিষ্কার করেছেন জীবক। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে কবিতা লিখলেন না।
শরীরের ভেতরে কোথাও ছন্দপতন ঘটলে তাকে নিখুঁতভাবে সাজিয়ে তোলার ভার নিলেন।
সময়
গড়িয়ে যাচ্ছে। তন্ত্রী সংযোজন এইমাত্র শেষ করলেন জীবক। ছেলেটি চোখ বুজে রয়েছে। রক্তপাত
বন্ধ হয়েছে। উত্তরের পাহাড় থেকে বাতাস আসছে। বৃষ্টিভেজা বাতাস। ছেলেটির মুখ একটু
একটু নড়ছে। আকুল হয়ে তাকিয়ে রইলেন জীবক। ছেলেটির মাঝে আবার সজীবতা ফিরে আসছে।
এই
নিস্পাপ ছেলেটির কল্যাণ হোক। পৃথিবীর কোনো মলিনতা যেন তাকে আর স্পর্শ করতে না পারে। সে যেন ভোরের
শুভ্র আলোর মতো হৃদয়বান হয়। তার দ্বারা মানুষের মঙ্গল সাধিত হবে। যেমন করে আলো ফসলের
চারাকে সমৃদ্ধ করে। তার দ্বারা দুখি মানুষের উপকার হবে।
তিনি
মনে মনে প্রার্থনা করলেন। ছেলেটি চোখ মেলেছে।
তুমি
কে? আমি... আমি... কঙ্ক...
কিশোরটির
উত্তর শুনে জীবক স্মিত হাসলেন। মাটি রক্তে ভেজা। তার উপর। দিয়ে কিছু কীটপতঙ্গ হেঁটে
যাচ্ছে। জীবন কী সুন্দর!
বরাহের
আক্রমণে নিহত এই ছেলেটির শবদেহকে এতক্ষণে হয়তো বনের পশুরা ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। এখন
ধীরে ধীরে সজীব হবে কঙ্ক। উষ্ণ রক্ত প্রবাহিত হবে তার শিরা-উপশিরায়।
ছেলেটি
নদীকে তরঙ্গায়িত হয়ে বয়ে যেতে দেখবে। পাখিকে দেখবে ডানা মেলে দিয়ে উড়তে! বীজ
থেকে জন্ম নিতে দেখবে চারাকে। কুঁড়িকে দেখবে ফুল হয়ে ফুটতে। গাছের ছায়ায় ছায়ায়
হেঁটে যাবে নিজের আশ্রয়ে। জীবকের জীবনে অনেক দুঃখ। কাউকে সে সব দুঃখের কথা বলা যায়
না। এই ছেলেটির মুখের শব্দ শুনে জীবনের সমস্ত দুঃখ ভুলে গেলেন জীবক। উজ্জ্বল আলোর ভেতরে
তাকে তখন খুব প্রসন্ন লাগছে।
সেই
ঘটনার দশ বছর পরের কথা। সমতট অঞ্চলে এক হিংস্র ডাকাত ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তার
নিষ্ঠুরতার কাহিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে গিয়েছিল। বন্য বরাহের মতো হিংস্র
স্বভাব ছিল সেই যুবক ডাকাতের।
ইতিহাসের
আতঙ্ক সৃষ্টিকারী এই যুবকের নাম কঙ্ক।
No comments:
Post a Comment