![]() |
রহস্য গল্প - প্রতিশোধ - আলী ইমাম |
রহস্য গল্প - প্রতিশোধ - আলী ইমাম
মানুষের
আর্তচিৎকারে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল রুদ্রের। বেশি শোনা যাচ্ছে নারী আর শিশুকণ্ঠের কান্না।
কুশি ঘাসে বোনা নরম চাটাই থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসল সে। মনে হচ্ছে বাইরে অসংখ্য লোক ছুটোছুটি
করছে। কুটিরের ঝপ খুলে দেখল তাদের কনকচূড় গ্রামটি তখন দাউদাউ করে জ্বলছে। মেঘনা তীরের
এই গ্রামটি মসলিন তৈরির জন্যে বিখ্যাত। রুদ্র বুঝল তাদের গ্রামে হার্মাদরা আক্রমণ করেছে।
ঝাপটা খানিক সরাতেই একটা বীভৎস দৃশ্য দেখতে পেল। তাদের গ্রামের কুশলি তাঁতি পবনকে বর্শাবিদ্ধ
করে একপাশে ফেলে রাখা হয়েছে। তার বুকে লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এই পবন তাঁতি চমৎকার
নকশাদার মনচোতি আর কলকি কাপড় বুনতে পারত। ভোরের শিশিরের মতো নরম ছিল সে সব কাপড়।
পানামের বণিকদের খুব পছন্দ কনকচূড় গ্রামের তাঁতিদের বোনা কাপড়। রুদ্র ভয়ার্ত চোখে
দেখে কয়েকজন লালমুখো হার্মাদ খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে যাচ্ছে। মশালের দপদপে আলোতে তাদের
মুখকে ভয়ঙ্কর দেখায়। তাদের মাথায় লাল কাপড়ের ফেটি বাঁধা। কনকচূড় গ্রামের বিভিন্ন
কুটিরের চালে মশাল ছুড়ে ছুড়ে মারছে তারা। অমনি দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে তাঁতিপাড়ার
কুটিরগুলো। হার্মাদরা তাঁতিদের
কুটির থেকে মসলিনের পেটিকা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
মাঝে
মাঝে মেঘনা তীরের গ্রামগুলোতে এভাবে নিঃশব্দে আসে পর্তুগিজ জলদস্যুরা। নিষ্ঠুরভাবে
হত্যা করে নিরীহ গ্রামবাসীদের।
রুদ্র
সাবধানে বের হয় কুটির থেকে। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে যায় তাদের বাড়ির পেছনের সেই রহস্যময়
স্থানটির কথা। জঙ্গলাকীর্ণ একটি জায়গা। দিনের বেলাতেও সেখানে থমথমে অন্ধকার। সেখানে
রয়েছে একটি ভগ্ন গড়। আগাছায় আর কাঁটালতায় ঢেকে থাকা ইটের ধ্বংসস্তুপ।
ভয়ে কেউ কখনও যায় না সেখানে। লোকে বলে অভিশপ্ত গড়। এক তান্ত্রিক সাধুর কাছে শুনেছিল
ওই গড়ে নাকি বহু অতৃপ্ত আত্মা রয়েছে। ওই অশরীরীরা সেখানে ঘুরে বেড়ায়। গড়ের ভেতরে
রয়েছে বাদুড়। রুদ্রের তখন মনে হলো তাকে দৌড়ে ওই গড়ের ভেতরে। গিয়ে লুকিয়ে থাকতে
হবে। তাহলে আর হার্মাদরা খুঁজে পাবে না। রুদ্র জানে যে কোনো মুহূর্তে তাকে জলদস্যুরা
হত্যা করতে পারে। অথচ সে কোনো অপরাধ। করেনি। কোনো কারণ ছাড়াই তারা মানুষদের হত্যা
করে থাকে। অসহায় মানুষদের হত্যা করতে পারলে তারা অদ্ভুত এক ধরনের বুনো আনন্দ পায়।
রক্তমাখা হাত তাদের উল্লসিত করে তোলে। হার্মাদদের চোখগুলো তখন কালো চিতার চোখের মতো
ধকধক করে জ্বলে। আশ্চর্য, এই লোকগুলোর মনে কি একটুও মায়া-দয়া
বলে কিছু নেই?
রুদ্র
হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে। তাদের পাড়াটি গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে। নদী এখান
থেকে কাছে। কয়েকজন হার্মাদ ছুটে যাচ্ছে। মশালের আলো দেখা যাচ্ছে। রুদ্র সাঁই করে বিষকাটালির
ঝোপের ভেতরে ঢুকে পড়ল। আর একটু হলেই তাকে দেখে ফেলেছিল জলদস্যুরা। রুদ্রের বুকটা ডাহুকের
ছানার মতো ধুকপুক করছে। বড্ড বাচা বেঁচে গেছে এবার। এতক্ষণে হয়তো তার ছোট শরীরটা বর্শায়
এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেত। আকাশ লাল। মানুষের কান্না। চারদিকে আর্তচিৎকার। তাদের কনকচূড়
গ্রামটিতে এখন লুটপাট হচ্ছে। হার্মাদরা তাদের লোভী থাবা বাড়িয়ে দিয়েছে এখানে। লুট
হয়ে যাচ্ছে তাঁতিদের তৈরি মসলিন বস্ত্র।
রুদ্র
বিষকাটালি ঝোপের ভেতর থেকে উঁকি দিল। কাউকে এখন আর আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। তাকে এখান
থেকে বেরিয়ে ভগ্ন গড়ের দিকে যেতে হবে। রুদ্র ওই গড়ে যাওয়ার জন্যে তখন তীব্র এক
আকর্ষণ অনুভব করল। তার ভেতরে কোত্থেকে যেন সাহসের তীব্র জোয়ার এসেছে। এই জোয়ার তাকে
ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। তার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে ভয়। রুদ্র সতর্কভাবে
এগিয়ে চলল গড়ের দিকে। চারদিক সুনসান। গড়ে নামার গোপন পথের সন্ধান সে জানে। সাপখোপের
ভয় রয়েছে। মানুষ হার্মাদরা যে সাপের চাইতেও হিংস্র।
ঘন
আগাছা সরিয়ে নিচে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি দেখতে পেল রুদ্র। এই পরিত্যক্ত গড়টির প্রতি
তার প্রচণ্ড কৌতূহল। সে শুনেছে এই রহস্যময় গড়ের নিচে রয়েছে এক গোপন সুরঙ্গপথ। যা
দিয়ে নাকি চণ্ডিকান-এর দুর্গে যাওয়া যায়। শাহজাদা সুজার নির্দেশে
তৈরি হয়েছিল ওই দুর্গ। হার্মাদদের আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্যে।
রুদ্র
একটি গাছের শক্ত ডাল ভাঙে। সেটা দিয়েই আগাছা, বুনো লতা সরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে
নামতে হবে তাকে। তার মনে এখন আর কোনো ভয়ডর নেই। কেউ যেন তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কনকচূড় গ্রামের কোনো লোক ভয়ে এই ভগ্ন গড়ে কখনও আসে না। তারা এটাকে মনে করে এক ভৌতিক
স্থান। রাতের বেলায় কখনও অদ্ভুত রকমের শব্দ শোনা যায় গড়ের ভেতর থেকে। মানুষের চাপা
কান্নার মতো শব্দ। রুদ্রের বহু দিনের কৌতূহল ছিল এই গড়কে নিয়ে। আগে কোনো দিন এর ভেতরে
নামতে সাহস পায়নি। আজ রাতে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাচার জন্যে বাধ্য হয়ে নেমেছে।
রুদ্র দেখেছে কীভাবে তাদের গ্রামের অসহায় মানুষেরা পালাতে চাইছে। হার্মাদদের আক্রমণ
কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না।
গড়ের
ভগ্ন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে রুদ্র। না জানি তাদের গ্রামের কত লোককে হত্যা করেছে
জলদস্যুরা। এই হার্মাদরা চুপিসারে আসে ছিপ নৌকা দিয়ে।
রুদ্র
গড়ের অনেকটা ভেতরে চলে এসেছে। জুলন্ত গ্রামের আলোতে পথ দেখে দেখে কোননামতে এগুতে পারছে।
বাদুড়েরা ঝুলে আছে কার্নিশে। ফরফর করে উড়ে যায় চামচিকা। ওর কাছে মনে হচ্ছে সে যেন
একটি দুর্গবাড়ির ভেতরে দিয়ে চলেছে। আশ্চর্য, তাদের গ্রামের মাটির নিচে এমন
একটি প্রাচীন দুর্গবাড়ি এভাবে গুপ্ত অবস্থায় ছিল? এর খবর তারা
এতদিনে কেউ সঠিকভাবে জানত না। গ্রামের কোনো কোনো প্রবীণ অবশ্য শোনাত এক অন্য রকম কাহিনি।
তারা বলত একজন অসম সাহসী নৌ-সেনাপতির কথা। বহুকাল আগে কনকচূড়
গ্রামের কাছে এক মুঘল নৌ-সেনা একটি ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল।
তার নাম ছিল সফদার খাঁ। অনেক নায়ের
মালিক ছিল সে। তার ছিল জলবা আর জোলিয়া নামের রণতরী।
রুদ্র
সেই সাহসী নৌ-সেনাপতির কথা শুনেছে। মেঘনার বুকে তরতরিয়ে ভেসে চলত তার যুদ্ধজাহাজ।
এখনও তার কথা বলে গর্ব করে মেঘনা পাড়ের গ্রামবাসীরা। তারা যেন দেখতে পায় ভরা বর্ষায়
উত্তাল মেঘনার ঢেউ ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সফদার খা নাওখোদার রণতরীগুলো। বাতাসে নৌকার পাল উঠেছে ফুলে। মেঘনার মোহনায় জলদস্যুদের জাহাজ
আক্রমণ করছে সফদার খাঁর জাহাজ। গর্জে উঠেছে কামান। মগদের জাহাজগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে
যাচ্ছে। তাদের পাল পুড়ে যায় আগুনে। জাহাজ ভেঙে যায় কামান থেকে নিক্ষেপ করা গোলার
আঘাতে। এখনও সেই সুসময়ের কথা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন প্রবীণরা।
রুদ্র
আচ্ছন্নের মতো গড়ের ভেতরে হাঁটছে। স্পর্শ করছে ভগ্ন খিলান।
দেখছে
বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ। অনেক বছর পর এখানে মানুষের পায়ের ছাপ পড়েছে। এতদিনের জমাটবাধা
নীরবতা আজ বুঝি ভেঙেছে।
রুদ্র
ভাবছে,
এটা কি তাহলে সফদার খাঁর নির্মিত সেই ঘাঁটি!
কনকচূড়
গ্রামের সুজন মাঝি বলত সেই সাহসী মানুষটির কথা। রণতরী নির্মাণে যে ছিল কুশলি। জানত
কোন কাঠে কোন তরী টেকসই হয়। বানাতে পারত বালাম, পারিন্দা, পাতেলা, সলব, রথগিরি, বজরা। তার পরিকল্পিত নৌকার সুনাম ছড়িয়ে গিয়েছিল অনেক দূর দেশে। সেই নৌকার
বহর দিয়ে মুঘল সৈনিকেরা তখন জলদস্যুদের হামলা প্রতিরোধ করত। সে জন্যে মেঘনাতীরের দুধালি,
কনকচূড়, চক্রদণ্ডি গ্রামের সুনাম ছিল প্রতিরোধের
জন্যে।
এখন
সেসব শুধু ইতিহাস। সব কিছুই হারিয়ে গেছে। সফদার খাঁর কথা অনেকেই হয়তো জানে না। তার
ঘাটি বিনষ্ট হয়েছে। তার দুর্গবাড়ি এখন ভগ্ন গড়। পরিত্যক্ত আবাস। আগাছায় ঢাকা। সাপখোপের
আস্তানা।
অনেকটা
পথ চলে এসেছে রুদ্র। তার শরীরে এখন শীতল বাতাসের স্পর্শ লাগছে। নদী তাহলে কাছেই। একটি
চত্বর পেরিয়ে যায় রুদ্র। তার শরীর ক্রমশ শিহরিত হচ্ছে। লোমকূপের গোড়া সিরসির করছে।
সে যেন এক প্রাচীন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। তার সামনে খুলে যাচ্ছে
রহস্যময় দরোজাগুলো।
তবে
কি এই ঘাঁটি থেকেই মেঘনার রণতরীগুলো একসময় নিয়ন্ত্রিত হতো? তখন
এদিকে হার্মাদারা আসতে সাহস পেত না। তাদের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছিল আতঙ্ক। এই ঘাঁটির
নিশ্চয়ই কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল। যাতে এখান থেকে আক্রমণ পরিচালিত হতো সহজে।
রুদ্র
হঠাৎ অনুভব করল তার ভেতরে ক্রমশ সাহসের বীজ রোপিত হচ্ছে। সেই বীজের খোসা ভেঙে রক্তের
ভেতরে জাগছে সাহসের লকলকে চারা।
হঠাৎ
একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠল রুদ্র। প্রথমে চোখ কচলে নিল। সে কি ঠিক দেখছে! তার
সামনে বাতাস ফুড়ে অবয়ব পেল একটি ছায়ামূর্তি। নদীর ঢেউয়ের মতো প্রথমে তরঙ্গায়িত
হলো মূর্তিটি। যেন উঠে আসছে নদীর নিচ থেকে। আবছা আলোতে দেখা গেল মূর্তিটা এগিয়ে যাচ্ছে।
রুদ্রের কানে বাজে ঢেউয়ের ক্ষীণ শব্দ। কার মূর্তি এটা? পোশাক
দেখে মনে হচ্ছে সেই মুঘল নৌ সেনাপতি সফদার খাঁ। রুদ্রের সামনে সফদার খাঁর অশরীরী মূর্তি! সে
সম্মোহিতের মতো চলেছে ওই মূর্তির পিছুপিছু। হঠাৎ করেই আবার যেন বাতাসের ভেতরে মিলিয়ে
গেল মূর্তিটা। ভগ্ন গড়ের ভেতরে বাতাস পাক খেয়ে উঠল। রুদ্রের সমস্ত শরীর বেয়ে একটা
হিমশীতল স্রোত কুলকুল করে নেমে গেল। তবে কি সফদার খাঁর অতৃপ্ত আত্মা ছায়ারহস্য হয়ে
তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? রুদ্র সামনের নেমে আসা বটগাছের
ঝুরিটিকে চেপে ধরল। আশ্চর্য, তার ভেতর থেকে সমস্ত রকমের ভয়ভীতি দূরীভূত
হয়েছে। রুদ্র যেন শুনল তার কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বলে উঠল-
-জাগে, মেঘনা
তীরের মানুষ জাগে, মেঘনা তীরের গ্রাম জ্বলে। আগুন জ্বলে ধিকিধিকি।
জাগে মানুষ। পালায় মানুষ। আমি কতকাল ধরে বসে থাকি। আসে না কেউ। আজ রাতে এসেছ তুমি।
তোমাদের গ্রাম যে এখন জ্বলছে। তুমি প্রতিশোধ নেবে না?
রুদ্র
ঘোরলাগা চোখে তাকায় ছায়ামূর্তির দিকে- নেব। নিতে চাই।
-তোমাদের
কনকচূড় গ্রামকে আজ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল হার্মাদরা। মারল শিশুদের। মারল তাঁতিদের।
তাদের কেটে টুকরো টুকরো করল। তুমি কি এর প্রতিশোধ নেবে না?
-কীভাবে
নেব? কী আমার সাধ্য? কতটুকু আমার ক্ষমতা?
-তোমাকে
ক্ষমতা অর্জনের বুদ্ধি দিতেই তো এসেছি আমি।
-কে
আপনি?
-আমি
জীবনে হার্মাদদের বহু ছিপ নৌকা ধ্বংস করেছি। আমার কাছে সেই কৌশল রয়েছে। এ এক গুপ্তবিদ্যা।
কতদিন ধরে অপেক্ষা করেছি। যখন দেখেছি নদীতীরের গ্রামগুলোকে হার্মাদরা জ্বালিয়ে দিচ্ছে
তখন অসহ্য ক্রোধে ছটফট করেছি। আমি যে এখন ছায়া। এই গুপ্তবিদ্যা প্রয়োগ করার শারীরিক
ক্ষমতা যে আমার নেই। তাই তুমি নেবে এর প্রতিশোধ।
-আমি
কি পারব?
-পারতে
হবে। হার্মাদরা এখন তোমাদের গ্রাম আক্রমণ করেছে। আমি কিছুই করতে পারছি না। এই দুর্গে
এমন ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি যাতে এখানে আসা জলদস্যুদের কোনো নৌকাই আর ফিরে যেতে পারবে
না। ওদের নৌকাগুলো কিন্তু সামনের বাঁকের কোণায় রয়েছে।
-কিন্তু
সেগুলো কীভাবে আক্রমণ করব? আমি যে একা।
-তুমি
একা নও। আমি তোমাকে কয়েকটি কৌশল শিখিয়ে দেব। এর ফলাফল হবে আশ্চর্যজনক। গুপ্তবিদ্যা
প্রয়োগ করব। তুমি কাজ করবে আমার বাহক হিশেবে।
-রুদ্র
দাঁড়িয়ে রয়েছে গড়ের চত্বরে। রহস্যময় আলোছায়ার খেলা চারপাশে। কোথাও তক্ষক ডাকে।
রুদ্র এখন বাহক হয়ে উঠবে। সে ধীরে ধীরে সম্মোহিত হয়ে পড়ছে।
-আমি
কোন কৌশলে ওদের আঘাত করব?
-আমি
এখন তোমাকে গড়ের গুপ্তঘরে নিয়ে যাব। সেখানে রয়েছে এক শেকল টানার যন্ত্র। এর সঙ্গে
সংযোগ আছে মেঘনা নদীর। এই দুর্গবাড়ির ছাদে রয়েছে মশাল তীর। সেগুলো আছে সারি সারি।
যখন জলদস্যুরা গ্রাম থেকে গিয়ে ওদের ছিপ নৌকায় উঠবে তখন
ওই শেকলঘরের যন্ত্র ঘোরাতে হবে। বর্শা মশাল জ্বালিয়ে রাখতে হবে আগে। চকমকি পাথর রয়েছে।
শেকলযন্ত্র নিপুণভঙ্গিতে ঘোরাতে পারলে জ্বলন্ত বর্শা মশালগুলো উড়ে গিয়ে বিধবে হার্মাদদের
ছিপ নৌকাগুলোতে। আর তখন নৌকাগুলো দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে।
রুদ্রের
শরীর শিরশির করছে। সে এখন রয়েছে প্রচণ্ড এক ঘোরের ভেতরে। তার মনে তখন কোনো প্রশ্ন
জাগছে না। জিজ্ঞাসার জন্ম হচ্ছে না। সম্ভব অসম্ভবের সীমানাটুকু যেন পেরিয়ে এসেছে।
শুধু মনে হচ্ছে প্রতিশোধ নিতে হবে। ভয়ঙ্কর এক প্রতিশোধ। তাদের গ্রামটিকে পুড়িয়ে
দেয়ার জন্যে হার্মাদদের উপরে প্রতিশোধ। তাদের গ্রামের নিরীহ মানুষজনকে অকারণে
হত্যা করার জন্যে হার্মাদদের ওপরে প্রতিশোধ।
অনেক
পাপ করেছে হার্মাদরা। তবে তারা কেন জিতে যাবে? অথচ রুদ্র প্রতিদিন ভোর বেলায়
নদীতীরের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করত, যেন তাদের গ্রামটি সুখে থাকে। তার প্রতিদিনের প্রার্থনা তাহলে বৃথা যায়নি।
সে কখনও কোনো পাপ করেনি। তার ভেতর দিয়ে হয়তো তাই সফদার খাঁর অতৃপ্ত আত্মা এবার জেগে
উঠেছে। তাই তার এই ভগ্ন গড়ে নেমে আসা। রুদ্র বুঝল নাওখোদার প্রতিশোধ এখন রূপায়িত
হবে তার ভেতর দিয়ে।
রুদ্র, এসো
আমার সঙ্গে। মশালগুলো জ্বালাবার ব্যবস্থা করো। চকমকি পাথর সংগ্রহ করো। এবার আমাদের
শেকল যন্ত্রের ঘরে যেতে হবে। হার্মাদদের ছিপ নৌকায় ওঠার সময় হয়েছে।
রুদ্রের
সামনে মিহি কুয়াশার মতো মূর্তি। মূর্তির কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে যেন নদীর নিচ থেকে। মনে
হচ্ছে পানির ভেতর দিয়ে ছলকে ছলকে আসছে শব্দমালা। এ এক অদ্ভুত রকমের অনুভূতি। ছায়ামূর্তির
পেছনে পেছনে রুদ্র হেঁটে যেতে লাগল।
কনকচূড়
গ্রামটি লুট করে হার্মাদরা যখন ছিপ নৌকাতে ফিরে এলো তখনি ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনা। হার্মাদরা
আতঙ্কিত হয়ে দেখল গ্রামের একটি অন্ধকার কোণা থেকে ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর মশাল।
তাদের সব ছিপ নৌকা সেই মশালের আগুনে জ্বলে উঠল। হার্মাদদের অনেকেই নিহত হলো তীরবিদ্ধ
হয়ে। তারা এই ঘটনাকে ভৌতিক ব্যাপার মনে করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। অনেক হার্মাদের
লাশ ভেসে গেল নদীতে।
মেঘনাতীরের
তাঁতিদের গ্রামগুলোতে এরপর আর হার্মাদরা আক্রমণ করেনি।
No comments:
Post a Comment