![]() |
রহস্য গল্প - পাহাড়ে প্রেতপুরী - আলী ইমাম |
রহস্য
গল্প - পাহাড়ে প্রেতপুরী - আলী ইমাম
মাস
দেড়েক ধরে টাইফয়েড জ্বরে ভুগে শয্যাশয়ী ছিলেন আর্থার ম্যাকলয়েড। নিজেকে এখন তার
যথেষ্ট দুর্বল মনে হচ্ছে। শরীরে আগের মতো তেমন জোর পান না। খুব কর্মতৎপর মানুষ ছিলেন
তিনি। অফিসে যতক্ষণ থাকতেন ততক্ষণ অতিরিক্ত আগ্রহে কাজ করতেন। কোনোদিন ছুটি নেবার কথা
মনে হয়নি। তার কর্তব্যনিষ্ঠার কথা ফিরত লোকের মুখে মুখে। অসুখের কারণে এতদিন অফিসে
যেতে না পারার জন্য ম্যাকলয়েড এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগছেন। ডাক্তাররা তাকে জানিয়ে
দিয়েছেন আরো দুমাস পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। হাওয়া বদল করা প্রয়োজন। যেতে হবে
কোনো পাহাড়ি শহরে। যেখানে হ্রদ রয়েছে। হ্রদের ধারে থাকতে হবে তাকে। তবেই তার শরীরের
অবসাদ ভাবটা যাবে কেটে। বিছানায় ম্যাকলয়েডকে এখন যথেষ্ট রোগপাণ্ডুর দেখায়। ডাক্তারের
এ প্রস্তাবটি শুনে খুশি হয়েছে ম্যাকলয়েডের বড় কন্যা এমিলিয়া। এতোদিন তাদের বাবাকে
কোনো জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতে পারেনি। কোথাও বেড়ানোর কথা শুনলেই চমকে উঠেছেন ম্যাকলয়েড।
অফিসের কাজের অজুহাত দেখিয়েছেন। বাবার প্রতি মনে মনে রাগ ছিল এমিলিয়ার। কাজ যেন আর
কেউ করে না। এভাবে একনাগাড়ে খাটুনির কোনো মানে হয়। ডাক্তারের প্রস্তাব শুনে সে চট
করে দূরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলল। পর্যটনের অফিস থেকে জোগাড় করল তথ্য।
স্কটল্যান্ডের এক নির্জন পাহাড়ি এলাকায় হ্রদ রয়েছে। হ্রদের ধারে ছোট ছোট কুটির।
সেখানে যায় স্বাস্থ্যসেবীরা। এমিলিয়া যাওয়ার সবকিছু গুছিয়ে ফেলল।
ম্যাকলয়েড
সাহেব বিপত্মীক। দুটি মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। এমিলিয়া আর এথিনিয়া। এমিলিয়ার চব্বিশ
বছর। এথিনিয়া তার দু’বছরের ছোট।
দূরে
কোথাও যাবে বলে দু’বোনের খুব খুশি। ধূসর, একঘেয়ে
শহরটাকে তারা তাহলে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। মালপত্র গোছানো হয়ে গেল। যাচ্ছে লম্বা সময়ের
জন্য টুকটাক মেলা জিনিশ গুছিয়ে নিতে হচ্ছে।
একদিন
ট্রেনে উঠল তারা। যাবে পাহাড়ি ছোট শহর রক লোভান। সেখানে রয়েছে টলটলে, স্বচ্ছ
হৃদ। তার তীরে কুটির। লোভান হ্রদের বুকে জলচর পাখিদের মেলা বসে। অপূর্ব এক স্থানে ঐ
হ্রদটি। নীল আকাশের মেঘের ছায়া পড়ে পরিষ্কার পানিতে। গাছে পাতায় কাঁপে ঝিরঝির করে।
পথের ধারে ফুটে থাকে নাম না জানা অসংখ্য বুনোফুল। ঘাসঝোপে পাখিদের বাসা। নাইটেঙ্গেলদের
দেখা যায় বেশি। সবচাইতে সুন্দর হচ্ছে ড্যাফোডিল ফুলে ছাওয়া প্রান্তর।
পাহাড়ি
শহর লেভানে এসে ওদের মনে হলো এতো নির্জন, শান্ত পরিবেশ তাহলে পৃথিবীতে
রয়েছে। মানুষজনের অহেতুক চিৎকার নেই। কোলাহল নেই। নেই গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ। কালো ধোয়া। প্রকৃতি এখানে স্নিগ্ধ, প্রসন্ন।
রোদ এখানে আলতো নরম। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। সমস্ত শহরে ভেসে বেড়ায় বনজ এক ধরনের
গন্ধ। অল্প লোকজন এই শহরে। বেশির ভাগই বায়ু পরিবর্তনে আসা। কখনও এথিনিয়া হ্রদের ধার
ছেড়ে একটু দূরে যেতে চায়। ছোট ছোট পাহাড়। টিলার গায়ে সবুজ ঘাসের বন। রঙ-বেরঙের ফুল। পাহাড়ের মধ্যে বেশ কয়েকটা গুহা তার চোখে পড়েছে। গুহার ভেতরে
অন্ধকার। ওদিকে কৌতূহলে তাকিয়েছে। যেতে সাহস হয়নি।
অ্যালান
তাকে নিষেধ করেছে পাহাড়ে বা গুহার ওদিকে না যাওয়ার জন্য। অ্যালান ছেলেটি আসে খয়েরি
রঙের একটি ঘোড়ায় চেপে। দূরের এক গ্রাম থেকে আনে দুধ, ডিম
আর তাজা সবজি। কখনও আনে গাছপাড়া ফল। এগুলো বিক্রি করাই তার পেশা। হ্রদের তীরে ঘুরে
ঘুরে সে এসব বিক্রি করে। অ্যালান এথিনিয়ার সাবধান করে দিয়েছে পাহাড়ি গুহার দিকে
না যাওয়ার জন্য। অথচ এথিনিয়ার ওদিকে তাকিয়ে কেন জানি মনে হতো, বনপাহাড়ের গাছগুলো তাকে বুঝি ডাকছে। সবুজ পাতা, রঙিন
ফুল, ডালপালা দুলে দুলে বলছে এসো, এসো। এথিনিয়া কখনও সাহস করে পাহাড়ে যেত। কিন্তু গুহার দিকে যেত না।
গুহার ভেতরে কেমন থিকথিকে অন্ধকার।
এক
সকালে এথিনিয়া বসেছিল হৃদের পাশে। মিষ্টি বাতাস বইছে। জলচর পাখিরা উড়ে উড়ে শরবনে
নামছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল জঙ্গলের দিকে। আশ্চর্য, কী প্রবল রঙের স্পর্শ
লেগেছে সেখানে। মনে হচ্ছে সমস্ত পাহাড়ে কে যেন লাল রঙের মস্ত এক গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে।
পাতাগুলো ফুলগুলো তাকে ডাকছে। এথিনিয়ার মন সেখানে যাবার জন্য আকুল হয়ে উঠল। এদিকে
ওদিকে তাকিয়ে এগিয়ে চলল সে পাহাড়ের দিকে। ছোট ছোট টিলাগুলো পেরিয়ে গেল। তাকে যেন
তীব্রভাবে টানছে জায়গাটা। আচমকা থেমে পড়তে হলো তাকে। সামনে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়।
সেই পাহাড়ের নিচে একটি গুহা দেখা যাচ্ছে। গুহার ভেতরটা তেমন অন্ধকার না। উল্টো দিক
থেকে প্রচুর আলো এসে পড়েছে। এটা যেন একটি গুহাপথ। অ্যালানের সাবধান বাণী তার আর মনে
রইল না। এথিনিয়ার মনে প্রচণ্ড কৌতূহল জাগল। গুহার ওপাশে বোধ হয় অনেক। সুন্দর দৃশ্য
রয়েছে ! এথিনিয়া কী এক আকর্ষণে ঢুকে পড়ল গুহাপথে। কিছুটা এগিয়ে
যেতেই শেষ হয়ে এলো পথটা। গুহার অন্য পাশে দেখল সুন্দর একটি সাজানো বাগান। সেই বাগানের
শেষপ্রান্তে সুন্দর, ছোট একটি বাড়ি।
নতুন
বাড়ি। ঝকঝক করছে।
-আশ্চর্য, পাহাড়ের
আড়ালে এতো সুন্দর একটি বাড়ি রয়েছে। এ যে ভাবাই যায় না। অ্যালান কখনও তোদের এ খবর
দেয়নি।
-এই
নির্জন এলাকায় কার এতো সুন্দর বাড়ি? কে এতো শখ করে পাহাড়ের উপরে
বানিয়েছে বাড়িটি।
হঠাৎ
এথিনিয়ার কাছে এসে দাঁড়াল এক ভদ্রমহিলা।
-সুপ্রভাত, আপনারা
কি এখানে বেড়াতে এসেছেন?
-হ্যাঁ। দিন পনের হলো এসেছি। উঠেছি ১৩ নং ভিলাতে। এদিকে আর কখনও আসিনি।
-আপনারা
রোজ হ্রদের ধারে বেড়াতে যান। আমার পক্ষে কোথাও যাবার উপায় নেই। ঘরে আমার স্বামী খুব
অসুস্থ।
-আপনারাও
তাহলে আমাদের মতো হাওয়া বদলের জন্য এসেছেন?
-না।
আমরা হলাম এখানকার বাসিন্দা। এই যে বাড়িটা দেখছেন এটা আমাদের। আমার স্বামী ছিলেন সেনাবাহিনীর
বড় অফিসার। যুদ্ধে গিয়ে একবার প্রচণ্ড আঘাত পান তিনি। বাঁচার কোনো আশা ছিল না। তার
স্নায়ুকোষগুলো যথেষ্ট দুর্বল হয়ে গেল। ডাক্তাররা বললেন, কামানের
প্রচণ্ড শব্দে তার মাথার শিরাগুলো খুব বেশি রকমের জখম হয়েছে। তাকে সুস্থ রাখার পথ
হলো খুব নিরিবিলি একটি জায়গায় গিয়ে বাস করা। তাই এখানে এসে বাড়ি করেছি। জায়গাটা
আসলেই যথেষ্ট নির্জন।
এথিনিয়ার
মনটা দুঃখে ভরে গেল। কে জানত, এই হাসিখুশি মহিলার জীবনে এতো চাপা দুঃখ
রয়েছে। ভদ্রমহিলা তখনও তাকিয়ে রয়েছেন এথিনিয়ার দিকে।
-দেখুন
তো, আমাদের পরিচয়টাই এতোক্ষণ হয়নি। আমার নাম এমা। কর্নেল ভগানের
স্ত্রী।
-আমি
এথিনিয়া ম্যাকলয়েড। আপনার নামের সঙ্গে আমার দিদির নামের মিল রয়েছে। দিদি এমিলিয়া।
এমা বলে ডাকি।
-তাই, তাহলে
তো আমি আপনার দিদি হয়ে গেলাম। চলুন, আমাদের বাড়ির ভেতরে।
ভদ্রমহিলার
চমৎকার ব্যবহার এমিলিয়াকে মুগ্ধ করেছে। মহিলা বাগনের গেট খুলে দিলেন। এথিনিয়াকে
ভেতরে যেতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। বাগান বাড়িটি কী সুন্দর। এথিনিয়ার তখন মনে পড়ল বড়
বোন এমিলিয়ার সাবধান বাণী। কোনো অপরিচিত মানুষ ডাকলে তাদের বাড়িতে যেয়ো না। এই মহিলা
তার কাছে অজানা। এভাবে তাদের এই নির্জন বাড়িতে যাওয়াটা মোটেই ঠিক হবে না।
এথিনিয়া
বলল, আজ থাক। বাড়ি
থেকে অনেকক্ষণ হলো বেরিয়েছি। দিদি হয়ত চিন্তা করছে। কাল বাড়িতে বলে আসব।
একথা
শুনে যেন ভদ্রমহিলার মুখটা কেমন রক্তশূন্য হয়ে গেল। গভীর হতাশার ছাপ পড়ল যেন। হঠাৎ
এথিনিয়ার চোখ পড়ল বাড়িটির ওপর। দোতলার সবগুলো জানালা খোলা ছিল। শুধু একটি জানালার
পাল্লা ভেজানো ছিল। সেই আধবন্ধ জানালার দিকে চোখ গেল এথিনিয়ার। কেন যেন তীব্রভাবে
তাকে আকর্ষণ করছে। সেদিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড রকমের চমকে গেল এথিনিয়া। ওখানে একটি বীভৎস
মুখকে দেখা যাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর, কদাকার দেখতে মুখটি। চোখ দুটো জ্বলছে। ঝাঁকড়া
চুল। চোখ দুটো পিশাচের মতো ধকধক করছে। সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি যেন আগুনের শিখার মতো ছুটে
এসে তার বুকে জ্বলুনি সৃষ্টি করল। এথিনিয়া হাত দিয়ে বুকটা চেপে ধরল। ছোটবেলা থেকেই
এথিনিয়ার গলায় ঝুলত একটি রুপোর হার। হারের মাঝে একটি ক্রুশ। এথিনিয়া চেপে ধরল ক্রুশটাকে।
তখন জ্বলুনিটা যেন ধীরে ধীরে কমে এলো। এথিনিয়া তাকিয়েছিল জানলার দিকে। সে ভদ্রমহিলার মুখের পরিবর্তনগুলো
দেখেনি। জানালার পাশে সেই বীভৎস মুখটা আর দেখা যাচ্ছে না। এথিনিয়ার মাথাটা টলছে। শরীরটা
অসুস্থ মনে হচ্ছে। সে ছুটে যেতে চাইল। কোনোমতে গুহাপথটা পেরুল। হঠাৎ তার মনে হলো ভদ্রমহিলাকে
বিদায় জানিয়ে আসা হয়নি। কী ভাববেন তিনি। এথিনিয়া তখন পেছন ফিরে চাইল। চরম বিস্ময়ে
হতভম্ব হয়ে গেল সে। এদিকে তার সামনে তখন কোনো কিছু নেই। ফুল বাগান নেই। ভদ্রমহিলা
নেই। সেই সুন্দর বাড়িটাও নেই। সব কিছু যেন ভৌতিকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সামনে উঁচু
নিচু পাথরে ভরা ভোলা প্রান্তর। শেষে একটি শ্যাওলা ধরা ইটের স্তুপ। এথিনিয়া তখন জ্ঞান
হারিয়ে সেখানে লুটিয়ে পড়ল।
সন্ধের
পরও এথিনিয়াকে বাড়ি ফিরে আসতে না দেখে সবাই অস্থির হয়ে পড়ল। ম্যাকলয়েড
সাহেব উন্মাদের মতো মেয়েকে খুঁজছেন। এমিলিয়া হ্রদের বুকে তোলপাড় তুলে জেলে ডিঙি
নামাল। সারারাত খোঁজ হলো এথিনিয়াকে। ভোরবেলা অ্যালান এলো দূরের গ্রাম থেকে খয়েরি
ঘোড়ায় চেপে। সব শুনে সে বলল, প্রেত ভিলাতে আবার যায়নি তো?
প্রেত
ভিলা কোথায়?
অ্যালান
তখন তাদের পাহাড়ি পথ ধরে নিয়ে গেল সেই গুহার মুখে। সেখানেই ঘাসঝোপে পাওয়া গেল মূর্ছিতা
এথিনিয়াকে। সারা রাতের শিশির ভিজে রয়েছে। ফ্যাকাশে চেহারা। যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে।
প্রচণ্ড জ্বরে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রলাপ বকছে, উঃ
আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কী ভয়ঙ্কর চোখ। আগুন। এথিনিয়াকে আনা হলো। অ্যালানের কাছে শোনা গেল সেই গা ছমছমে কাহিনি।
ঐ
যে সেখানে দূরে একটি ঢিবি দেখেছিলেন ওটাই ছিল প্রেত ভিলা। একসময় তা ছিল কর্নেল ভগানের
বাড়ি। কী যে নিষ্ঠুর স্বভাবের ছিল লোকটা। একেবারে নরকের কীট। পাপিষ্ঠ। কোনো সদগুণ
ছিল না তার মাঝে। প্রচণ্ড অত্যাচারী। কোনো একটি যুদ্ধে জয়লাভ করে ক্ষমতার প্রবল দম্ভে
সে উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করল। শেষ জীবনে এই পাহাড়ি এলাকায় এসে ভিলা করল। মারা গেল
এক দুর্ঘটনায়। হ্রদের ধারে তার দগ্ধ লাশ পাওয়া গেল। বজ্রাঘাতে তার মৃত্যু হয়েছিল।
তারপর প্রেত হয়ে সে রয়ে গেছে তার ভিলাতে। তার স্ত্রীও হয়েছে পেতনী। এখানকার পুরনো
বাসিন্দারা এসব জানে। কেউ ভয়ে সেদিকে যায় না। কর্নেল ভগান মারা গেছে প্রায় দুশো
বছর আগে। সেই থেকে বহু মানুষ ওদের পাল্লায় পড়ে মারা গেছে। ঐ বাড়ির মধ্যে ঢুকলে আর
রক্ষা নেই। প্রেতপুরী ওটা। মিস্টার ম্যাকলয়েড ঠিক করলেন তখনি ঐ অভিশপ্ত অঞ্চলটি ছেড়ে
চলে যাবেন। তিনি স্টেশনে ছুটলেন টিকিট কাটার জন্য।
No comments:
Post a Comment