![]() |
রহস্য গল্প - তৃতীয় নয়ন - আলী ইমাম |
রহস্য গল্প - তৃতীয় নয়ন - আলী ইমাম
কাঠবাদাম
গাছের বড় বড় পাতার ছায়ায় দুপুরটা যেন স্থির হয়ে আছে। জিউলির সরু সরু ডাল দিয়ে
তিতাশের বাড়ির সামনের দিকটা ঘেরা। কয়েকটা মাঠচড়াই সেখানে পোকামাকড় খুঁটছে। সে বাড়িতে
টালির ছাদ। বাগানে অনেকগুলো কলাবতি গাছ। হলুদ ফুলগুলোতে লালের ছিটে। আরও আছে জামরুলের
গাছ। খুব টসটসে ফল হয়। জামরুলের পাকা ফল পাখিরা ঠুকরে খেয়ে ফেলে দেয়।
আমাদের
এই ছোট শহরে তিতাশের খুব নাম। স্কুলে পড়তেই
ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিদেশ থেকে অনেক পুরস্কার পেয়েছে। খবরের কাগজে
ওর হাসি মুখের ছবি ছাপা হয়েছিল। ওদের স্কুলের ড্রইং টিচার বলতেন, তিতাশ
খুব নামকরা শিল্পী হবে। তোমরা দেখে নিও। তুলির জোর ওর সাংঘাতিক।
একবার
পুরস্কার আনতে টোকিও গিয়েছিল তিতাশ। তখন খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিল আমাদের ছোট মফস্বল
শহরে। টাউন হলে ওর সম্মানে এক অনুষ্ঠান হলো। এসডিও সাহেব
ছিলেন সভাপতি। আমরা দেখেছিলাম ফুলের মালার নিচে কীভাবে ডুবে যাচ্ছে লাজুক ছেলে তিতাশ। খুব ইচ্ছে হতো ওর সঙ্গে গল্প করি। রাস্তায় ওর পাশাপাশি হাঁটি।
টোকিও
থেকে আসার পর ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওর ঘরে চেরি ফুলের রঙিন ছবি টাঙানো। তিতাশ খুব আস্তে করে কথা বলে। কথা বলার সময় মুখটাকে নিচু করে
রাখে। জাপানের অনেক ছোট ছোট দ্বীপ ঘুরে এসেছে তিতাশ। তার সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিল! এর
গ্রামের ছেলেরা কেমন করে কোরমারেন্ট নামের চকচকে পাখি পুষে তা দিয়ে মাছ ধরে। পাখিগুলোর
গলায় আংটা বাঁধা থাকে। তাই ওরা মাছ গিলতে পারে না। জেলেরা নৌকা করে
কোরমারেন্ট নিয়ে নদীতে যায়। বিলে যায়। পাখিগুলোর দীঘল গলা। কুচকুচে কালো দেখতে।
পানকৌড়ির মতো ডুবে ডুবে মাছ তুলে আনে। পাখিগুলোর পা নৌকার সঙ্গে শেকল দিয়ে আটকানো। জাপানে বসে ওর আঁকা একটি ছবি তিতাশ আমাকে দেখাল। কয়েকটি কোরমারেন্ট
ঠোটে করে মাছ নিয়ে উঠে আসে। নলখাগড়ার ঝোপের পাশে জেলেদের ডিঙি
নৌকা।
তিতাশ
আমাদের একটি দ্বীপের কথা বলল। মিতিসাই। সেখানে আছে এক সরাইখানা। আশ্চর্য ধরনের খাবার
পাওয়া যায় সেখানে। বুনো পশুপাখির খাবার। বনজ লতাপাতার খাবার। জাপানের প্রাচীন নিয়মে
সেখানে রান্না হয়। অনেকেই শখ করে খেতে আসে। এই সরাইখানার খাবার তালিকা তিতাশকে
খুব বিস্মিত করেছিল। খাবারের একটি পদ ছিল পাহাড়ি বাজপাখির কলিজার সুপ। অনেক উঁচুতে
বাসা বাঁধে ওই বাজপাখিরা। তাদের ধরতে হয় অনেক কষ্ট করে। ওই সরাইখানাতে কয়েকজন শিকারি
ছিল। তাদের কাজ বনে জঙ্গলে ঘুরে তালিকা অনুযায়ী পশুপাখি মেরে আনা। শিকারে তীর ধনুকের
ব্যবহার হতো। উত্তরের পাহাড়ি
এলাকায় এক ধরনের বন্য তিতির দেখা যায়। সেই তিতিরের ঝলসানো রোস্ট সেখানে পাওয়া যেত।
ইউক্যালিপটাস গাছের ডালে আগুন জ্বালিয়ে তার তাপে ঝলসানো হতো সেইসব বন্য তিতির। ইউক্যালিপটাসের
ডালে পাতায় লেবুর মতো এরকম গন্ধ মিশে থাকে। সেই মিষ্টি ধোয়াতে ঝলসানো মাংশের স্বাদ
নাকি অপূর্ব হতো।
তিতাশ
বেশ কিছু জাপানি গানের রেকর্ড এনেছিল। সেগুলো শুনলাম। একটি গানের কথা কী সুন্দর।
চেরি
চেরি
মার্চ
মাসের আকাশের
যত
দূর দেখা যায়
শুধু
চেরি আর চেরি
এমন
সুগন্ধ কোথা থেকে আসছে।
মেঘের
মাঝ থেকে না কুয়াশার মাঝ থেকে
এসো
এসো, আমরা সাকুরা দেখতে যাই।
এ
দেশের ছেলে-বুড়ো সবাই নাকি এ গান গায়। কমনওলথের একটি প্রতিযোগিতায় সোনার
পদক পেয়ে আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরের তিতাশ আরও বিখ্যাত হয়ে উঠল। টেলিভিশন থেকে ওর
একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে সে কুরুলিয়ার খালে সূর্যোদয়ের বর্ণনা করে
বলেছিল, তার খুব দুঃখ যে সে ওই রকম রঙ কাগজে ফুটিয়ে তুলতে পারে।
আমার
তখন মনে হচ্ছিল শীতের ভোরের কুয়াশায় শিরীষ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মুগ্ধ
কিশোরকে।
এক
বিকেলে ঝাউগাছের ছায়াতে আমি আর তিতাশ হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ ও চোখে হাত দিয়ে রাস্তার
মাঝে বসে পড়ল।
-কী
হলো, কী হলো তিতাশ?
-কী
যেন একটা পড়েছে। চোখটা খুব জ্বলছে।
হাত
সরাতেই দেখলাম ওর বাম চোখটা টকটকে লাল হয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি
রুমালে ভাঁপ দিয়ে ওর চোখে চেপে ধরলাম। তিতাশ খুব ছটফট করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই
ওর বাম চোখটা অসম্ভব ফুলে উঠল। তাড়াতাড়ি ওদের বাসায় নিয়ে গেলাম। সারাটা পথ তিতাশ
যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সে রাতেই ওকে
মিশন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
ডাক্তাররা
ওকে পরীক্ষা করে বললেন, চোখের ব্যাপার। খুব খারাপ দিকে টার্ন নিতে পারে।
ওকে শহরের চোখের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। তিতাশদের বাড়ির সবার মুখই থমথমে। তিতাশ
শুধু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। মাঝরাতে ট্রেন। তাতে ওকে শহরে নিয়ে যাওয়া হলো। স্টেশনে অনেকেই খবর পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সবার মন খারাপ
করে দিয়ে ট্রেনটা তিতাশকে নিয়ে অন্ধকারের দিকে চলে গেল। যতক্ষণ ট্রেনটাকে দেখা যায়
ততক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ট্রেনের কামরাগুলো থেকে আলো ছিটকে ছিটকে আসছে। যেন নিকষ অন্ধকারের
ভেতরে চলন্ত একটি আলোর মালা হারিয়ে গেল।
দুদিন
পর খবর পেলাম। তিতাশের চোখের অপারেশন করা হবে। ওর চোখের কর্নিয়া একেবারে নষ্ট হয়ে
গেছে। আই ব্যাঙ্ক থেকে অন্য লোকের একটি চোখ পাওয়া গেল। লোকটি তার চোখ দান করে গিয়েছিল।
সেটাই দেয়া হলো : তিতাশকে। নতুন চোখ পেল। তিতাশ এক মাস পর সুস্থ
হয়ে ফিরে এলো।
আমি
অবাক হয়ে তিতাশকে দেখছিলাম। ওর বাঁ চোখটা অন্য লোকের। একটু শুকিয়ে গেছে। কেমন গম্ভীর
থাকে।
-তিতাশ, ছবি
আঁকবি ?
-ভাল্লাগে
না। ওর নির্লিপ্ত উত্তর। শুনে আমার খুব খারাপ লাগে। তিতাশ ছবি আঁকার জন্য কোনোরকম উৎসাহ
পাচ্ছে না।
-জানিস
তিতাশ,
সিউলে এ বছর ছবির একটি বিরাট প্রতিযোগিতা হবে। সেখানে ছবি পাঠাবি না?
নতুন না পাঠালে পুরানোগুলোই না হয় পাঠিয়ে দে।
তিতাশ
এ ব্যাপারে মোটেই উৎসাহ দেখায় না। টেবিলে একটা পেন্সিল কাটার ছুরি ছিল। সেটা দিয়ে
টেবিলটার একপাশ খোচাতে থাকে। বাইরে কাঠবাদামের গাছ থেকে কয়েকটা পাখি
ডানা মেলে ঝটপট করে উড়াল দেয়। কিছু শুকনো পাতা খসে যায়।
সামনে
পরীক্ষা। দিনরাত বাসায় থাকি। কোথাও যাওয়া হয় না। একদিন তিতাশদের বাড়িতে গেলাম।
ওর ছোট বোনকে দেখি বারান্দায় বসে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
-কী
টুনি,
কাঁদছিস যে।
-আমার
পোষা পায়রাটাকে কে যেন মেরে ফেলেছে।
-কোথায়?
টুনি
আমাকে ওদের বাড়ির পেছন দিকে নিয়ে যায়। একটা কলাবতি গাছের নিচে শাদা পায়রাটা মরে
পড়ে আছে। পায়রাটার গলাটাকে কেউ যেন মুচড়িয়ে ভেঙে দিয়েছে। লাল পিঁপড়েরা হেঁকে
ধরেছে মরা পায়রাটাকে। টুনি ফুলে ফুলে কাঁদছে। দৃশ্যটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগতে থাকে।
কতদিন দুপুর বেলায় ওদের বাসায় গিয়ে দেখেছি টুনি ওর পোষা পায়রাকে গম, ছোলা
খাওয়াচ্ছে।
সেদিন
তিতাশের সঙ্গে আমার দেখা হয় না।
একদিন
তিতাশের স্কুলের সেই ড্রইং টিচারের সঙ্গে দেখা। বাজার করে ফিরছেন! মুখে
খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আমাকে দেখেই থামলেন।
-এই
যে বাবা,
তিতাশের খবর কি? শুনলাম ও নাকি ছবি আঁকা ছেড়ে
দিয়েছে? খুব খারাপ... খুব খারাপ। আমি ওর
জন্য কত কষ্ট করে পিকাসো, মাতিস ভ্যান গগের ছবির অ্যালবাম আনিয়েছি।
-ও
জানি কেমন হয়ে গেছে। ছবি আঁকায় কোনো উৎসাহ নেই।
-জান
বাবা,
আমার বড় স্বপ্ন ছিল ওকে নিয়ে। জয়নুল আবেদিনের মতো ছবি আঁকবে। দুর্ভিক্ষের
ছবি। মানুষের কষ্টের ছবি। দামি তুলির দামি রঙের কোনো দরকার নেই। খসখসে কাগজে কয়লার
টুকরো দিয়ে আঁকলেই হবে।
আমার
মনে হলো বৃদ্ধ শিক্ষক একটু যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
এক
সন্ধে বেলায় কুরুলিয়ার খালের কাছ দিয়ে হেঁটে আসছি। সামনেই জেলেপাড়া। ঝুপসি ঝুপসি
অন্ধকার নেমে আসছে। কয়েকজন লোককে দেখলাম সামনে জটলা পাকিয়ে রয়েছে। এক বুড়ি খুব
চিৎকার করছিল। সেখানে এগিয়ে যেতেই অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখলাম। কয়েকটা বড় রাতা মোরগ
মরে আছে। সবকটার মাথা মুচড়িয়ে ভাঙা। বুড়িটা মোরগ, মুরগি, হাঁস পুষতো। বাজারে ডিম, ছানা
বিক্রি করত। কে মেরেছে এমন নিষ্ঠুরভাবে প্রাণীগুলোকে?
আমার
হঠাৎ মনে হলো টুনির সেই পায়রাটার কথা।
কুরুলিয়ার
খালের সাঁকোর উপর দেখলাম তিতাশকে। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঝুকে কী যেন দেখছে।
-তিতাশ।
একটু
যেন চমকে উঠল।
-কী
দেখছ?
-নৌকা।
অনেক দূর থেকে এসেছে। লাল আলু, মেটে আলু বোঝাই করে। দেখো না লোকগুলো রান্না
করছে। কীভাবে ধারালো বঁটি দিয়ে তাজা মাছ কাটছে।
সাঁকোর
ওপর থেকে সব দেখা যায়। নৌকাগুলোতে মিটমিট করে আলো জুলছে। সে আলো খালের পানিতে থিরথির
করে কাঁপছে। একটি নৌকা থেকে ভাঙা গলায় গান ভেসে আসছে। এলোমেলো বাতাসে কুপিগুলো দপদপ
করে জ্বলতে থাকে। সাঁকোর নিচে বসে একটি লোক ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল। সে বেশ একটি বড় মাছকে
টেনে তোলে। আবছা অন্ধকারের ভেতরে মাছটি চকচক করতে থাকে।
-আচ্ছা, মাছ
কাটার সময় কী মজা! কেমন কচাৎ কচাৎ করে কেটে ফেলছে। অথচ দেখ,
এই মাছটাই একটু আগে হয়তো খালের ভেতরে কী দুরন্তভাবে ছুটে যাচ্ছিল।
আমি
সন্ধের অন্ধকারের ভেতরে তিতাশের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ওর মুখটাকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।
কী রকম করে কথা বলছে তিতাশ। আমার কাছে ভীষণ খারাপ লাগে। পরীক্ষার পড়ার তাড়া। তাই
চলে আসি।
সমস্ত
শহরে সেদিন তোলপাড়। মিশন স্কুলের দারোয়ানকে কে যেন খুন করেছে। দারোয়ানটার লাশ পাওয়া
গেছে পলাশ গাছের নিচে।
সারা
শহরে ফিসফিস আলোচনা। চাপা আতঙ্ক। মিশন স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে দারোয়ান খুব প্রিয়
ছিল। আজগুবি ধরনের গল্প বলতে পারত। এই ঘটনায় মিশন স্কুলের সব ছেলেমেয়ের মন কেমন খারাপ
হয়ে গেল। আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরটিতে এই হত্যাকাণ্ড যেন একটি শীতল পরশ দিয়ে গেল।
সেটা
ছিল এক অমাবস্যার রাত। সমস্ত শহর যেন অন্ধকারের ভেতরে ডুবে আছে। রাস্তার বাতিগুলোতে
চুপসানো আলো। কবরস্থানের
পাশ দিয়ে আসছি। বুনো ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ। একটা বকের বাচ্চা কোথা থেকে কেঁদে উঠল। শরীরটা
ছমছম করে ওঠে।
সামনের
ঝোপটা একটু নড়ে উঠল। একটা শিয়াল বুঝি হুঁস করে পালিয়ে যায়। রাস্তার বাতির ম্লান
আলোতে আমি দেখলাম ঝোপের ভেতর থেকে মানুষের একটা পা বেরিয়ে আছে।
আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। একটু পর মনে হলো মানুষের সাড়া পাচ্ছি। কয়েকজন পথচারী
আমার চিৎকারে দৌড়ে এলো। আমি হাত তুলে
ঝোপটা দেখিয়ে দিলাম। একজন সাহসী লোক গিয়ে ঝোপটা সরাতেই দেখা গেল একটি মৃতদেহ। রক্তে
ভেসে গেছে জায়গাটা। লোকটাকে এখানে খুন করা হয়েছে।
নীরব
আতঙ্কের একটি স্রোত বয়ে গেল আমাদের পুরো শহরের উপর দিয়ে। কে এই হত্যাকারী?
পরপর
আরও দুটো হত্যাকাণ্ড হলো। দুজনের লাশই
পাওয়া গেল নিরিবিলি রাস্তার পাশে। এরপর সন্ধে হলেই সমস্ত শহরটা দারুণ ভয়ে থমথম করতে
থাকে। কে জানে, কোথাও ওঁৎ পেতে আছে হত্যাকারী। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল
হত্যাকারীকে। তার কোনো চিহ্নই পাওয়া যাচ্ছে না। খুনির উদ্দেশ্যও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
বিভিন্ন ধরনের লোক খুন হয়েছে। নিহত লোকদের কোনো জিনিশ খোয়া যায়নি।
টুনি
আমাকে একদিন তিতাশের আঁকা কয়েকটা নতুন ছবি দেখিয়েছিল। টকটকে লাল রঙ দিয়ে আঁকা। ছবিগুলোর
বিষয়বস্তু অদ্ভুত। কয়েকটি প্রাণীর মৃতদেহ। তার একটারও আবার মাথা নেই। কী সব বীভৎস
দৃশ্য আঁকছে তিতাশ।
টুনি
বলল, কী যে করে ভাইয়া। একদিন ঘুম ভেঙে দেখি মাঝরাতে বাড়ি ফিরছে।
আমাদের
বাড়িতে সেদিন রাতে কয়েকজন অতিথি এসেছে। মা বললেন কুরুলিয়ার খালের জেলেদের কাছ থেকে
টাটকা দেখে বড় একটা মাছ কিনে আনতে। অনেক সময় সেখানে বেশ ভালো মাছ কিনতে পাওয়া যায়।
আমার সেখানে একলা যেতে সাহস হলো না। পাশের বাড়ি থেকে হাসানকে সঙ্গে নিলাম। কুরুলিয়ার
খালে যাওয়ার পথটা খুব নির্জন। একটা বড় বাঁশঝাড় পার হয়ে যেতে হয়।
দিনের বেলাতেই সেখানে থমথমে অন্ধকার।
চৌধুরী
ভিলার কাছ দিয়ে সময় দেখি পাঁচিলের উপর একটা কালো বেড়াল বসে আছে। বেড়ালটা আমাদের
দেখে ফ্যাচ করে মাধবীলতার ঝাড়ের ভেতরে লাফ দিল। ঝাড়টা দুলে উঠল।
সামনে
একটা বিরাট বটগাছ। চারদিকে ঝুরি নেমে এসেছে। মাটিতে লাল বটফল থেঁতলে আছে। বটগাছের ডালে
নানা রঙের কাপড়ের টুকরো ঝুলছে। বটগাছের পাশে একটি গর্তে কয়েকজন লোক কলাগাছের শুকনো
পাতা এনে আগুন ধরাচ্ছে।
হাসান
জিজ্ঞেস করে,
-কী
করছ?
-ভাম
মারছি। এইসব গর্তে উদবিড়াল, ভাম, বাঘরোল থাকে।
মাঝে মাঝে খাদালরা এসে এক মেরে চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে যায় ।
আবার
রাস্তাটা নিরিবিলি হয়ে আসে। শনশন করে বাতাস বইছে। চারপাশে মেটে জ্যোৎস্নার আলো। এদিকে কোনো বাড়ি ঘর নেই। নিচু জমি। হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার শুনি।
বাঁ দিকের শ্যাওড়া ঝোপের কাছ থেকে আসছে চিৎকারটা। ঝটপট শব্দ হয়। একজন দৌড়ে পালায়
সামনের দিকে। আমি আর হাসান তাড়াতাড়ি সেখানে যাই। মাঝবয়েসী এক লোক উপুড় হয়ে পড়ে
আছে। পিঠে রক্তের ছাপ। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের কয়েক সেকেন্ড লাগে। হত্যাকারী
পালিয়েছে। আমাদের শহরে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী হত্যাকারী সামনের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। একের
পর এক খুন করেছে সে। স্নান জ্যোত্সায় তার ছায়ামূর্তি দেখা যাচেছ । হাসান চিৎকার করে ওঠে, খুন, খুন বলে। যারা গর্তের কাছে
ভাম মারার জন্য ছিল তারা দৌড়ে আসে। আমরা হাত তুলে খালের দিকে পালিয়ে যাওয়া খুনিকে
দেখাই। সবাই সেদিকে ছুটতে থাকে। ওকে আজ যে করেই হোক ধরতে হবে।
কুরুলিয়ার
খালের পাশ দিয়ে খুনি দৌড়ে যাচ্ছে। পেছন পেছন আমরা। আমাদের সঙ্গে একজন খাদাল ছিল।
ও ডাং ছুড়ে মারল। ডাং মেরে ওরা খরগোশ ধরে। ডাংটা গিয়ে খুনির পায়ে আঘাত করল। লোকটা
অমনি হোঁচট খেয়ে ধানী জমিতে পড়ল। কয়েকজন লোক গিয়ে তাকে জাপটে ধরে। হাসান টর্চ জ্বালে
খুনির মুখের উপর। আমি দারুণ আতঙ্কে ফিসফিসিয়ে শুধু বলি, তিতাশ
।
তিতাশকে
শহরের কোর্টে চালান দেয়া হয়েছে। বিচার চলছে। আমি শহরে গিয়ে একটা খোজ নিয়েছিলাম।
চোখের হাসপাতালের একজন ডাক্তার ফাইল ঘেঁটে বলল, তিতাশ চৌধুরী নামের একজন কিশোরের
বাম চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য সেটা তুলে সেখানে যার চোখ দেয়া হয়েছিল সেটা ছিল একজন
মারাত্মক খুনির চোখ। ফাঁসির আসামি সেই খুনি মৃত্যুর কিছু দিন আগে তার চোখ দুটি আই ব্যাংকে
দান করে গিয়েছিল।
No comments:
Post a Comment