![]() |
রহস্য গল্প - যদি যায় জানা – আলী ইমাম |
রহস্য
গল্প - যদি যায় জানা – আলী
ইমাম
ঘরের
দেয়াল কচি কলাপাতার মতো রঙ দিয়ে ডিস্টেম্পার করা। বিছানায় শুয়ে তাকালে চেখে একটা
নরম ছায়া ভাসে? আর যদি জানালার ভারী পর্দা টেনে দেয়া যায় অন্তুর তখন মনে
হয় ঘরের ভেতরে ঝুপ করে কালো বেড়ালের মতো অন্ধকার লাফিয়ে পড়ল। জানালার পর্দা সরাতেই
চোখে পড়বে সেই দীঘল গাছটা। এই সময়ে যে গাছের ডালগুলো ভরে যায় আশ্চর্য রকম সুন্দর
সব ফুলে। জারুল গাছটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্তু। কোনো পাখি কি উড়ে এসে
ডালে বসছে? বাসা বানাতে চাইছে? এই বিশাল
দশতলা ফ্লাটবাড়ির ছ তলায় থাকে অদ্ভুরা। এতো লোকজন রয়েছে ফ্লাটবাড়িতে তবুও অন্তর
মনে হয় কেউ যেনো কারো সঙ্গে কথা বলে না। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। ছোটবেলা
থেকে অন্তুর শরীরটা খারাপ। প্রায়ই জ্বর হয়। বাঁ পাটা কেমন অসাড় হয়ে আসছে দিন দিন।
বিনু আপা তাকে একদিন বলেছিল, তুই আর কোনোদিন ভালো হবি নারে অম্ভ। তোর
অসুখটা খুব খারাপ। অন্তুর মাঝে মাঝে মনে হয় শেলফের কোণায় পড়ে থাকা কমিক বইগুলোর
ভেতর তুলতুলে হাঁসের ছানা ডোনাল্ড ডাক প্যাক প্যাক করে তাকে বলছে, হ্যালো, মাই ফ্রেন্ড, আমার সঙ্গে
যাবে নাকি? সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চমৎকার একটা দ্বীপে যাচ্ছি। সেখানে
পান্নার মতো সোনা রোদ ঝলমল করছে।'
অন্তু
তখন উঠে বসতে চায়। বাঁ পা চিনচিন করে ওঠে। অজস্র ব্যথার স্রোতা ছড়িয়ে যায় সবখানে।
ও যেনো দেখে ঘরের কোণায় রহস্যময় হাসি হাসছে স্পাইডার ম্যান। ফিসফিস
করে স্পাইডার ম্যান বলছে, আমি তোমাকে নিয়ে যাব। এই মেট্রোপলিন শহরের সবগুলো
উঁচু বাড়ির ডিঙিয়ে আমি তোমাকে মেঘের দেশে নিয়ে যাব। আমি স্পাইডার ম্যান যে কোনো
জায়গায় ছড়িয়ে দিতে পারি জাল। আর সেই জাল বেয়ে এগিয়ে যেতে পারি তরতর করে।
বইয়ের
খসখসে পাতার ভেতর থেকে উঁকি মারছে মিকি মাউস। অন্তুকৈ দূর কোথাও নিয়ে যাবার হাতছানি
দিচ্ছে মিকি মাউস।
নিঝুম
দুপুরে যখন লোকজন থাকে না তখন কেমন ঘোর লাগে অন্তুর। ওর টেবিলে রয়েছে সেই রহস্যময়
ট্যাবলেটগুলো। কোয়েল পাখির
ডিমের মতো ট্যাবলেটগুলোর রঙ। যেগুলো খেলে ওর চোখের সামনে রহস্যময় কুশায়া ঘনিয়ে আসে।
অন্তু আবছা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দেখে তুষার ঝড়ের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ছে বুনো
হাঁসের ঝাঁক।
বাড়ির
সবাই ওর সঙ্গে বেশি কথা বলে না। তাই অন্তুর খুব অভিমান। ও কি সবার কাছে একটা বোঝা? টোকাই?
ও কি. পথের ধারের নুলো ভিকিরি? দেয়ালে মৃত মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠতে চায় অন্তু।
ছোটবেলায় গরম ভাতের সঙ্গে কাগজী লেবুর রস মাখিয়ে ভাত খাওয়াত মা।। সেই মা এখন দূর
আকাশের তারা। অন্তর কত ইচ্ছে করে জ্বরের পর থানকুনি পাতার ভর্তা খাবে! তাতে জিভের তেতো ভাবটা কেটে যায়। অন্তু ভয়ে সে কথা কাউকে বলতে পারে না।
একদিন
শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা অন্তুর। কোয়েল পাখির ডিমের মতো অনেকগুলো ট্যাবলেট খেয়ে ফেললো
অন্ত। তার পরপরই অন্তর শরীরের ভেতর ঝিলিক দিয়ে উঠলো একটা চিনচিনে ব্যথার স্রোত। বিচানা
থেকে উঠতে চাইলো সে। তার আগেই মূর্ছিত হয়ে পড়ল অন্তু। ঘরের কোণায় সারা দুপুর আর
বিকেল আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইলো সে। জ্ঞান ফিরল সন্ধের পর। তখন
বাড়ির লোকজন বাইরে থেকে ফিরতে শুরু করেছে। ক্যাঁচ করে শব্দ হলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে অন্তুর সৎ মা। সেদিকে তাকিয়ে চমকে গেল
অন্তু। তার মনে হচ্ছে এটা হিংস্র বাঘের মুখ যেনো ঘরে ঢুকছে। সে কি তবে কিছুদিন আগে
দেখা সেই সায়েন্স ফিকশন ছবির কিশোর নায়কের মতো হয়ে গেছে? সে
কিশোর মানুষের মুখের আদলে দেখতে পেত নানার ধরনের জন্তুর চেহারা। কখনও হিংস্র,
ভয়ঙ্কর, কখনও কোমল ও মায়াবী? কে ঢুকছে ঘরে? ওর মা নাকি একটা হিংস্র বাঘ? মায়ের সাতে এগিয়ে আসছে তার দিকে,
-কিরে
অন্তু,
এখানে পড়ে আছিস যে?
তার
মনে হয় একটা থাবা এগিয়ে আসছে তার দিকে। অন্তু কেমন ভয়ে কুঁকড়ে যায়। পেছনে সরে
আসতে চায় ও। এমন সময়ে ঘরে ঢোকে কাজের বুয়া। অন্তুর মনে হয়, বুয়া
যেনো একটা পুরনো কালের দিঘির বড় মৃগেল মাছ। শরীর থেকে বেরুচ্ছে একটা শ্যাওলা ভেজা
ঠাণ্ডা বাতাস। যেনো অন্তর জ্বরতপ্ত শরীরটাকে কোমল পরশে জড়িয়ে রাখবে। এগিয়ে আসছে
অন্তুর মা। চিৎকার করে উঠল। বাঘ যেনো তাকে থাবা দিয়ে ছিড়ে ফেলবে। জানালার দিকে দৌড়ে
গেল অন্তু। তাকিয়ে দেখলো ফ্লাটবাড়ির সদর দরজা দিয়ে মস্ত অজগর সাপ ঢুকছে। আর্তচিৎকার
করে উঠল, সাপ-সাপ-সাপ।
অন্তুর
সৎ মা জানালার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
-কোথায়
সাপ? কী দেখছিস? অন্তু নিচের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,
ঐ যে সাপ! অজগর সাপ। গেট দিয়ে ঢুকছে।
-তোর
কি মাথা খারাপ হয়ে গেল অন্তু? ও যে তোর বিন্দু মামা। অন্তু নামের রোগে
ভোগা অসহায় সরল কিশোর ছেলেটি কি আর জানে তার বিন্দু মামা তাকে এ বাড়ি থেকে একটি অনাথ
আশ্রমে ভর্তি করার কাগজপত্র নিয়ে ফ্লাটবাড়ির সিঁড়ি
বেয়ে উঠে উপরে আসছে।
No comments:
Post a Comment