![]() |
রহস্য গল্প - বাদাবনের হাতছানি - আলী ইমাম |
রোদের
ঝাঝ একটু কমে আসতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাংলাবাজারের কাছে ছোট্ট একটি দোকান
আছে। চমৎকার সবজির চপ বানায়। সেখানে গেলে কজন বন্ধু পাওয়া যাবেই। বন্ধুদের সঙ্গে
গল্প করার জন্যে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ছোট্ট দোকানটিতে অসম্ভব ভিড়। এক কোণায় দেখি টুনু
ভাইকে। আমাকে দেখেই হইহই করে উঠলেন।
ভালোই
হলো তোকে পেয়ে। তোর তো আবার পুরনো বইগুলোর ঘাঁটার অভ্যেস আছে। আজ এক বাড়িতে নিয়ে
যাব। ওরা কিছু পুরনো বই বিক্রি করবে। নে, চপ খা?
চপগুলোর
উপর থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছে। বেশ কয়েকটা সবজির চপ তেঁতুলের চাটনির সাথে মিশিয়ে খেলাম।
সঙ্গে কুঁচি কুচি করে কাটা পুদিনার পাতা ছিল। টুনু ভাইয়ের সঙ্গে শুনে আমি ভেতরে ভেতরে
উৎসাহিত হয়ে উঠি। পুরনো বই খোজার আমার এক দারুণ রকমের নেশা।
একসময়
ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে। পাশের টেবিলে একটি কিশোর সিলেটের হাওরে যে সত্যি সত্যি স্কাইল্যাবের
টুকরো পড়েছে সেটাই এক বন্ধুকে আপ্রাণভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছে। বর্ষাকালটা শেষ হয়ে
এলেই ওরা সেখানে একটি অভিযান চালাবে বলেও ভাবছে।
টুনুভাই
ডিমের কারি খেতে খেতে বললেন, কপাল বটে ওই অস্ট্রেলিয়ার থর্নটন ছোঁড়াটার।
নিজেদের বাগানে প্রথম কুড়িয়ে পেল স্কাইল্যাবের টুকরো।
আমেরিকার
কোনো এক পত্রিকায় সেই টুকরোটা প্রথমে গছিয়ে দিতেই কড়কড়ে দুলাখ টাকা পেয়ে গেল।
সেই
পত্রিকাটির নাম সানফ্রান্সিসকো একজামিনার। আমি জানিয়ে দেই।
দোকানগুলোতে
আলো জ্বলে উঠেছে। এতক্ষণ ধরে লোডশেডিং চলছিল। গাড়িঘোড়ার অবিরাম শব্দ। একটি মেয়েকে
তার মা বোধ হয় করুণ সুরে ডাকছে। কে জানে, মানুষের এই ভিড়ের মাঝে মেয়েটি
হারিয়ে গেছে কিনা। টুনুভাই পকেট থেকে কাগজ বের করে ঠিকানাটি দেখে নেন। ফরাশগঞ্জে বাসা।
আমরা দু’জন দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকি।
রাস্তার
দু’পাশে শুধু দোকান
আর গুদামঘর। শুকনো মশলা উঁই করে রাখা। লাল মরিচের পাহাড়। পেঁয়াজের স্তূপ। এদিককার
দোকানগুলোতে মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ। পেছনেই নদী। দূরের গ্রামগুলো থেকে নৌকা বোঝাই করে
কাঁচা তরিতরকারি আসছে।। বাড়িটিকে খুঁজে বের করি। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে টুনুভাই
ঠিকানাটি মিলিয়ে দেখলেন। পুরনো তিনতলা বাড়ি। নিচতলায় একটি কবিরাজি ওষুধের দোকান।
রঙচটা সাইনবোর্ডে নানা রকমের ওষুধের নাম। একটি লোক একজনের কাছ থেকে হরিতকি কিনছে।
তাকে
জিজ্ঞেস করতেই বলল, যিনি বই বেচবেন তিনি তিনতলায় থাকেন। সোজা সিঁড়ি
দিয়ে উপরে উঠে যেতে হবে।
একটি
পাগল বসেছিল সিঁড়ির দোরগোড়ায়। সে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। সিঁড়ির মাথায় অল্প
পাওয়ারের আলো জ্বলছে। একটি শাদা কালো মেশানো রঙের বেড়াল ধুপ করে নেমে দৌড়ে পালাল।
আমি
আর টুনুভাই কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে তিনতলায় উঠে এলাম। দরজা খোলা। ঘরের মাঝখানে একটি
পুরনো আমলের পালঙ্ক। নানা ধরনের কারুকাজ করা। একটি বিরাট বাজপাখি যেন ডানা মেলে উড়ে
আসছে। কাঠের উপর এই নকশাটি চমৎকার ফুটেছে। পালঙ্কে চাদর মুড়ি দিয়ে ফ্যাকাশে চেহারার
এক বৃদ্ধ শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে একজন যুবক দাঁড়ানো। যুবক তালপাখা দিয়ে বৃদ্ধকে বাতাস করছিল। আমাদের চোখে পড়তেই এগিয়ে
এলো টুনুভাই। বললেন পুরনো বই বিক্রির কথা।
কথাটা
কানে যেতেই বৃদ্ধ লোকটি আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, আসুন,
বসুন। খুব টানাটানি যাচ্ছে বলে বইগুলো বিক্রি করছি। এসব আমার দাদামশায়ের
সংগ্রহ। তার বই জমাবার বাতিক ছিল। খুব দুপ্রাপ্য কিছু বই আছে। জেমস টেলরের টপোগ্রাফী
অব ঢাকার প্রথম সংস্কারণটি আছে। ঢাউস আকারের বই। কি, জেমস
টেলরের নাম কোনোদিন শোনেননি বলে মনে হচ্ছে! তা শুনবেন কোথেকে।
তিনি তো আর ছায়াছবির অভিনেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন ১৮০৮ সালের ঢাকা শহরের ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিল সার্জন। ঢাকার আশপাশের অঞ্চল নিয়ে চমৎকার রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন।
সেটাই তো ওই বই।
একনাগাড়ে
কথাগুলো বলে বৃদ্ধ হাঁপাতে লাগলেন। আমি আর টুনুভাই হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি কুশনে
বসে শুনছি।
ঢাকার
আদি ইতিহাসের উপর বিদেশি কিছু লেখা আছে। আমি একবার ঢাকার পুরনো কিছু রাস্তার নামের
ইতিহাস লিখে ইংরেজী পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম, ছাপেনি।
বৃদ্ধ
লোকটি পালঙ্কে ঠেস দিয়ে উঠে বসেছেন। যুবকটি তাকে শাদা পাথরের গ্লাসে পানি খেতে দিল।
আগের
দিনে ধুপখোলার মাঠে বুলবুলির লড়াই হতো। ঢাকার রইস আদমিরা
মাঠে তাঁবু ফেলত। খাঁচাভর্তি বুলবুলি। লাল বুলবুলি। সেপাই বুলবুলি । সাংঘাতিক লড়াই হতো। একপাখি অন্যপাখির
উপর ঝাপিয়ে পড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাতো। ঠোট দিয়ে কামড়ে
পেট ফুটো করে দিত। তাই দেখে উত্তেজিত লোক বাহবা দিত। বাজি ধরত।
ফরাশগঞ্জের
এই বৃদ্ধ লোকটির চোখে তখন হারিয়ে যাওয়া দিনের স্বপ্ন। সেসব দিনগুলোকে এরা বড় যত্ন
করে আগলে রাখে। যেন মলিন না হয়ে যায়।
খুব
কষ্ট করে এসব পুঁথিপত্তর জমিয়ে রেখেছি। আমি চোখ মুদলেই তো সব লুটেপুটে নিয়ে যাবে।
মুদি দোকানের ঠোঙা হবে।।
আমি
ঘরটির চারদিকে তাকাতে লাগলাম। বিভিন্ন লতাপাতার ছবি ঝোলানো।
বুঝলেন, একসময়
অর্কিডের চাষ করতাম। বলধার জমিদারকে বহু চারা দিয়েছি। তার শখটা ভালো লাগতো। খুব উৎসাহ ছিল। আমাজান থেকে পদ্মফুলের বীজ আনিয়ে শঙ্খনিধির দিঘিতে
ফুটিয়েছিলেন। ইয়া বড় বড় পাতা। একটা মানুষের বাচ্চাকে সে পাতার উপর দিব্যি বসিয়ে
রাখা যেত। এসব কথা আজকালকার লোকেরা জানে? সব তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার
শহরের দুপ্রাপ্য সব গাছপালা কেটেকুটে সাফ করে দিচ্ছে। বলধা বাগানের সেই দারুচিনি গাছটা
এখনও আছে, না নেই?
বৃদ্ধ
লোকটি কথা বলতে ভালবাসেন। কথা বলার সময় তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে থাকে। দেখলেই বোঝা
যায় বহু বছরের কথা জমে আছে। শোনাবার লোক পান না। সবাই হয়তো অবহেলা করে যায়। তাই
এক ধরনের চাপা অভিমানে গুমড়ে মরেন।
আমি
কিন্তু দায়ে পড়ে বইগুলো বিক্রি করছি। দরদাম না করলেই খুশি হব। আলো, পাশের ঘর থেকে বইগুলো নিয়ে এসো তো।
একটা
অদ্ভুত সুরে সামনের দেয়ালঘড়ির ভেতর থেকে ছোট্ট পেতলের পাখি ডেকে সময় জানিয়ে দিল।
যুবকটি অনেকগুলো বাঁধানো বই নিয়ে এলো। বেশ কিছু বই
মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো। বৃদ্ধ লোকটি
যা দাম চাইলেন, টুনুভাই তা দিয়েই কিনে নিলেন।
সেই
পুরনো বাড়ি থেকে নেমে আমাকে কয়েকটা বই দিয়ে বললেন, রাতে
ভালো করে এগুলো উল্টোপাল্টে দেখ। কাল দুপুরে আমার বাসায় আসবি। বইগুলো নিয়ে তখন আলাপ
করা যাবে।
আমি
খুব খুশি হলাম বইগুলো পেয়ে। কেমন পুরনো গন্ধ। নানিবাড়ির ট্রাঙ্ক খুললে এ রকম
গন্ধ পাওয়া যায়। ন্যাপথোলিন মেশানো গন্ধ। অনেকগুলো বইয়ের পাতা হলদেটে, ঝুরঝুরে।।
সিঁড়ির
গোড়ায় সেই পাগলটা তেমনি বিড়বিড় করে আপন মনে হাসছে। কবিরাজি দোকানটা বন্ধ করে দেয়া
হচ্ছে। হলুদ চাঁদ উঠেছে আকাশে। ইলেকট্রিকের তারে একটা মরা কাক ঝুলে আছে।
সে
রাতেই মাথার কাছে টেবিলল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বইগুলো পড়তে বসলাম। একটি বই নেপালের পাহাড়ি
অঞ্চলের সাধুদের উপর লেখা। এসব সাধুরা এক ধরনের রহস্যময় গাছের শেকড় খেয়ে দীর্ঘজীবী
হয়। সেই গাছের শেকড়ের নাম রুণ। আরেকটি বই মঙ্গোলিয়ার যাযাবরদের জীবনযাত্রা নিয়ে
খেলা। তারা কীভাবে ঘাসজমিতে বুনোঘোড়া নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়। বুনো তিতির দিয়ে অন্য
পাখিদের শিকার করে।
বইগুলোতে
বেশকিছু কাঠের ব্লকের ছবি ছাপা হয়েছে। তাতে ছবিগুলোকে একটু রহস্যময় লাগে।
বইগুলোর
ভেতরে একটি খয়েরি চামড়ায় বাঁধানো খাতা চোখে পড়ল। সবুজ কালিতে গোটা গোটা করে লেখা।
কিছুটা পড়েই বুঝলাম একজনের ডাইরি সেটা। দেড়শো বছরের পুরনো। বৃদ্ধ লোকটির দাদামশায়ের ডাইরি নাকি! বেশ
গুছিয়ে লেখা। জয়দেবপুরের জঙ্গলে একবার ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে বাঘ শিকার করতে গিয়েছিলেন।
আরেকবার শীতের সময় কক্সবাজারে ভ্রমণ করতে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন
এভাবে, এ স্থানের বাজারগুলি সাময়িক, ইহাতে
অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্যই ক্রয় বিক্রয় হইয়া থাকে। সমস্ত বাজার ছিল মৎস, টুনামাছ, হাঙর, কস্তুরি প্রভৃতি
সামুদ্রিক দ্রব্যসম্ভারে পরিপূর্ণ। এই স্থানের প্রধান বাজারে নাম মেলিবাজার। সাব ডিভিশনাল
অফিসার মেকান্টিশ সাহেবের দুহিতার নামে এই মেলিবাজার হইয়াছে। একটি উচ্চ পর্বতের অধিত্যকা প্রদেশে
একখানা সুন্দর গৃহ দেখিয়া দর্শনের অভিলাষ জন্মিল। গৃহটি চীনঘর নামে পরিচিত। কেন এই
নাম হইল,
জিজ্ঞাস করিয়া জানিতে পারিলাম, চীন দেশের বৌদ্ধ
মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত বলিয়া ইহার এই নাম হইয়াছে।
ভদ্রলোক
খুব ঘুরতে পছন্দ করতেন। তার দিনলিপির বিবর্ণ পাতায় কয়েক মাসের বিবরণ রয়েছে। জাফলঙয়ের
প্রকৃতি তাকে খুব আলোড়িত করেছিল। কীভাবে আরও পরিকল্পিতভাবে কমলার চাষ বাড়ানো যায়
তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। স্পেন থেকে জলপাই চারা এনে সেখানে চাষ করা যায় কিনা
সেটা নিয়েও ভেবেছেন।
এই
রকমের ভ্রমণ করতে গিয়ে তাকে কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি পড়তে হয়েছিল। গারো পাহাড়ে
এক কাপালিক তাকে আক্রমণ করে। কাপালিক তার পিঠে বাঘ-নখের থাবা বসিয়ে দিয়েছিল। এক মিশনারির
সেবায় তিনি সেবার সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সেই
রাতে ডাইরিটি পড়তে পড়তে আমি রীতিমতো রোমাঞ্চিত হই। যেন অন্য এক পৃথিবীতে বারবার হারিয়ে
যাই। এক শক্ত কব্জীওয়ালা লোককে আবিষ্কার করি। যিনি জীবনকে সারাজীবন মনে করে এসেছেন
একটা বুনো মোষ। তার দুটো শিঙ তীব্রভাবে ধরে লড়াই করে গেছেন। লোকটির নানা বিষয়ে কৌতুহল
ছিল। ডাইরি পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন দেড়শো বছর আগের কোনো
এক দিনে চলে গেছি। শহর ঢাকার রাস্তায় তখন পালকি। নবাববাড়ি থেকে হাতির মিছিলে যায়।
ফিটন গাড়ি, ছ্যাকড়া গাড়ি যায়। ফরাশগঞ্জের কাছে বুড়িগঙ্গা
নদীর তীরে ফরাসিদের বেশ কিছু কুঠিবাড়ি গড়ে উঠেছে। চন্দননগর থেকে পালতোলা বজরা আসছে।
পাদরিরা ছাপাখানা বসাচ্ছে। একজন লোক হাসিমুখে যেন আমাকে সেসব দিনের কথা বলছেন।
টেপ
রেকর্ডারে একটি জাপানি সঙ্গীত মৃদু সুরে বাজছিল। সঙ্গীতের নাম চেরি ফোটার দিন। এত সূক্ষ্ম
কারুকাজ আছে সঙ্গীতটিতে যে মন হয় পাতা ঝরার শব্দও ওতে বুঝি মিশে আছে। ডাইরির এক জায়গায়
এসে মনে হলো কয়েকটি পাতা যেন একটু পুরু। ভাল করে লক্ষ্য করতেই বুঝলাম সেখানে পাতাগুলো
খুব। সূক্ষ্মভাবে সেলাই করে জোড়া লাগানো হয়েছে। কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পেলাম। ড্রয়ার
থেকে ব্লেড বের করে খুব সাবধানে খুললাম। খুলে দেখি অল্প কিছু কথা লেখা,
‘এ কথা কাহাকেও
বলি নাই । সুন্দরবন ভ্রমণের
সময় চুনকুড়ি নদীর নিকট কৈখালি গ্রামে আমি এক বৃদ্ধ বাওয়ালির সাক্ষাৎ পাই। তাহার
নাম সিদ্দাই বাওয়ালি। লোকটি খালি হাতেই কয়েকটি বাঘকে মারিয়াছিল । আমি যখন তাহার সাক্ষাৎ পাই তখন সে মৃত্যুপথযাত্রী। সে জানায় গড়
মুকুন্দপুরে গুপ্তধন রহিয়াছে।।
মহারাজ
প্রতাপাদিত্যের গুপ্তধন। ঘড়া ঘড়া মোহর। তাহার নিশানা কৈখালি গ্রামের শ্মশানঘাটের
কাছের পাকুড় গাছের নিচে একটি হাতির দাঁত নির্মিত বাক্সে রহিয়াছে। সেখানে খুব সাপের
ভয় থাকায় আমি যাইতে পারি নাই। শহরে আসিয়াই আমি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী
হইয়া পড়ি। এই কথা কাহাকেও বলা হইল না।'
পড়তে
পড়তে আমার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। পুরনো আমলের এই ডাইরির পাতায় সুন্দরবনের গুপ্তধনের
সংবাদ!
এখনও হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠল রহস্যের
ঘেরা বাদাবন। ভাটির দেশ। গাছ-গাছালির ভেতরে গড় মুকুন্দপুরের
ক্ষয়ে যাওয়া বাড়ি। নোনাধরা ইট। শ্যাওলাছছাপা দেয়াল। সাপের খোলস বাতাসে ফিনফিন করে
ঝুলছে। পাচার ডাক। ডাইরির হলদেটে, মুচমুচে পাতাগুলো যেনো নিকষ
কালো অন্ধকারের ভেতরে আমাকে নিয়ে গেল। ছলাৎ ছলাৎ করছে চুনকুড়ি। ছোট্ট গ্রাম কৈখালি।
শ্মশানঘাটের পাকুড় গাছের পাতা কাঁপছে বাতাসে। যে গাছের ডালে হয়তো শকুনের বাচ্চারা
মাঝরাতে কাদে। সেই গাছের নিচে আছে গড় মুকুন্দপুরের নিশানা। মাটির নিচে এখনও কি হাতির
দাঁতের বাক্সটি আছে? সেখানে কী অজস্র সাপ কিলবিল করছে?
জ্যোৎস্নার আলোতে সাপকে নাকি রুপোলি ঝালর বলে মনে হয়।
সারারাত
আমার ঘুম এলো না। টেপ রেকর্ডারে কখনও মেক্সিকোর পাহাড়ি গানের ক্যাসেট দিলাম। কখনও
স্পেনের ফ্লেমিঙ্গো নাচের সুর। তবু সবকিছুকে ছাপিয়ে জেগে রইল গড় মুকুন্দপুরের ভাঙা
চুড়ো। রাতটা ছটফট করে কাটালাম। কখন সকাল হবে।
কখন টুনুভাইয়ের কাছে যাব।। শেষরাতের দিকে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। দেখলাম, গহীন
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ডালপালা সরিয়ে আমি আর টুনুভাই হেঁটে যাচ্ছি। আমাদের সামনে পথ দেখিয়ে
নিয়ে যাচ্ছে একজন বাওয়ালি। ঝকড়া ঝাঁকড়া তার চুল। লোকটা অরণ্যের মাঝে একটি পরিষ্কার
জায়গায় আমাদের নিয়ে গেল। সেখানে ছোট একটি বেদি। তার উপর টকটকে লাল রঙের নিশানা টাঙানো। বড় বড় মশাল জ্বলছে। কয়েকজন লোক হঠাৎ রাম দা হাতে ছুটে এলো। তারপর চিৎকার করতে করতে পশুপাখি বলি দেয়া শুরু করল। আমাদের দিকে
ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল ঘুঘু, বটের আর হরিয়ালের রক্তমাখা মাথা। মশালের
আলোতে লোকগুলোর চেহারা কী রকম ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। কখনও মুখগুলো কাছে আসছে আবার কখনও
দূরে সরে যাচ্ছে। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে।
তখনও
রাস্তাঘাটে লোক চলাচল ভাল করে শুরু হয়নি। টুনুভাইয়ের দরজার শিকল জোরে জোরে
নাড়তে থাকি। সদ্য ঘুমভাঙা টুনুভাই দরজা খুলে আমাকে ও রকম উসকো-খুসকোভাবে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যান।
-কি
হয়েছে?
সারারাত ঘুমাসনি?
-এটাই
আমাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। বলে আমি সেই ডাইরিটি তুলে ধরি।
-কি
এটা?
-দেড়শো
বছরের পুরনো এক ডাইরি।
-পেলি
কোথায়?
-কাল
তুমি যে বইগুলো দিয়েছিলে তার মধ্যে ছিল এটা।
-কী
আছে এতে?
-গড়
মুকুন্দপুরের রাজা প্রতাপাদিত্যের গুপ্তধনের নিশানা!
টুনুভাই
এবার চমকে যান। ঢোক গিলে বলেন,
-কি
সব বলছিস এই সাত সকালে। তোর কি মাথা বিগড়ে গেল নাকি?
আমি
ফিসফিস করে বলি,
-ঘড়া ঘড়া মোহরের খবর আছে টুনুভাই। সব বলছি। আগে এক কাপ চা খাওয়াও। দরজাটা
বন্ধ করো। তারপর সব বলছি।
-এক কাপ আদা চা খেয়ে শরীরটা বেশ ভালো লাগে। ডাইরির সব কথা খুলে বলি টুনুভাইকে।
তিনি মন দিয়ে শোনেন। ডাইরিটি খুলে দেখেন। চট করে সিদ্ধান্ত নিতে টুনুভাইয়ের জুড়ি
নেই। শান্ত গলায় তিনি শুধু বললেন, আজ রাতের ট্রেনেই আমরা খুলনা
যাচ্ছি। ঠিকমতো গোছগাছ করে নে।
রাতের
ট্রেন চলেছে সাঁই সাঁই করে। ফর্শা চেহারার এক ভদ্রলোক হিচককের একটি বই পড়ছিলেন। আমি
টুনুভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
-তুমি জানো, ভয়াল ছবির রাজা বলা হয় কাকে?
টুনুভাই
ঝিমুতে ঝিমুতে বললেন, -জানি না। এখন একটু ঘুমুতে দে তো।
-“আলফ্রেড হিচকক,” বলে
আমি লোকটির হাতে ধরা বইটির দিকে তাকাই। কেন জানি মনে হয় ফর্শা লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে
মিটিমিটি হাসছেন।
-তুমি হিচককের কোনো ছবি দেখছো? লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে
জিজ্ঞেস করে। পরের পর্ব লিঙ্ক
No comments:
Post a Comment