![]() |
choto golpo,Bangla translation,story of life,অনুবাদ গল্প,জীবনের গল্প,The Little black boys,বাংলা অনুবাদ |
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
টেবিলের উপরে হাজিরা-বই, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন শিক্ষিকা মিস
কেরী। আজই বসছে বছরের প্রথম ক্লাস। ছেলেরা কাড়াকাড়ি করছে পিছনের আসনগুলি নিয়ে। ওদের
সঙ্গে পেরে উঠবে না বলেই মেয়েরা সামনে বসছে, ওদের মুখগুলো গোমরা।
ছেলে-মেয়ে সবাই বসে পড়েছে যখন, দুটি রোগাটে ছেলে ভয়ে ভয়ে
এদিকে-ওদিকে তাকাতে তাকাতে ক্লাসে ঢুকল, আর পিছনের দিকে একবারও চোখ না বুলিয়ে সমুখেরই দুটো খালি সীটে বসে পড়ল ধপাস্
করে।
সমস্ত ক্লাসের দৃষ্টি একসঙ্গে এসে পড়ল ঐ ছেলে দুটোর
উপরে, পড়ল মিস কেরীরও। পড়বার সংগত কারণ
আছে। ছেলে দুটো কালো। পঞ্চাশটা সাদা ছেলেমেয়ের ভিতরে দুটি মাত্র নিগ্রো বালক। এক ঝাঁক
রাজহাঁসের ভিতরে দুটো পাতিকাক যেন।
কিছুদিন আগেও এরকম দৃশ্য মার্কিন মুলুকের যে-কোন স্কুলে কল্পনাতীত ছিল। কিন্তু হালে (বর্তমানে) আইন পাস হয়ে
গিয়েছে, সাদাদের স্কুলেও কালোদের প্রবেশাধিকার থাকবে। আইন অমান্য
করা চলে না, তা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের কাছে সে আইন যতই অরুচিকর
হোক।
সীট যখন আছে, তখন নিতেই হবে কালো ছেলেদের, নিতে বাধ্য স্কুলের কর্তারা।
সম্ভবতঃ সাদা ছেলেরা আগে থেকেই কানাঘুষা শুনেছে এ-ব্যাপারটার।
কারণ কালোদের দেখে তারা কোনরকম হইচই করে তো উঠল না! রূঢ় দৃষ্টিতে
সবাই একবার ওদের দিকে তাকাল, তা ঠিক, কিন্তু
কোন উৎপাত করবার চেষ্টা তো দেখা গেল না কারও। বাড়ি থেকে অভিভাবকেরাই তালিম দিয়ে দিয়েছেন,
বোঝা গেল। বলে দিয়েছেন যে কালোদের সঙ্গে মিত্রতা বা শত্রুতা কোনটাই
করার দরকার নেই। স্রেফ উপেক্ষা করে যাবে, দেখেও দেখবে না।
তাই করছে সাদা ছেলে-মেয়েরা। মিস কেরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। গোলমাল হলে পড়াশুনাও পণ্ড হত,
তার জেরও গড়াতে থাকত অনেকদূর। আইনের সঙ্গে জনমতের সংঘর্ষ তো কোন অবস্থাতেই
আনন্দের নয়!
কালো ছেলে দুটির নাম স্যামুয়েল আর হ্যামুয়েল, সংক্ষেপে স্যামি আর হ্যামি। দুই যমজ ভাই ওরা, দেখতে একরকমই, তবে এতখানি একরকম নয় যে কোনটা স্যামি
আর কোনটা হ্যামি, তা চেনা যাবে না।
দিন যায়। মিস কেরী ওদের দিকে একটু বিশেষ নজর রেখেছেন।
না রেখে উপায় নেই, কারণ ছেলে দুটো
সারাক্ষণ তার একেবারে সামনেই বসে আছে, আর প্রায় নিষ্পলক চোখে
তাকিয়েই আছে তার মুখের দিকে। গিলছে যেন তার প্রত্যেকটা কথা। এমন অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে
আর কোন ছেলে বা কোন মেয়ে তার কথা শোনে নি কোনদিন।
সাদারা ছায়া মাড়ায় না এদের। টিফিনের ছুটি যেটা হয়, সেইটাই ছেলেমেয়েদের খেলাধুলো হুল্লোড়ের সময়। স্যামি-হ্যামিকে কোন খেলায় যোগ দেবার সুযোগ কেউ দেয় না, তারাও
সে সুযোগের জন্য হ্যাংলামি করে না কখনও। এইটাই বিশেষ করে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে মিস কেরীর।
শুধু মনোযোগ নয়, শ্রদ্ধাও। এদের একটা আত্মমর্যাদাবোধ আছে। গরিবকেও
যা গরীয়ান্ করে তুলতে পারে, সেই মর্যাদাবোধ।
ওরা এই টিফিনের সময়টাতে কী করে তাহলে? চওড়া সিঁড়ির এক কোণে বসে কৌটো থেকে খাবার বার করে,
আর তাই চিবোয়। শুকনো রুটি, তার সঙ্গে নামমাত্র
উপকরণ কোনদিন হয়ত কিছু থাকে, কোনদিন বা থাকেও না হয়ত। অন্য
ছেলে-মেয়েরা তখন হয়ত স্কুলেরই খাওয়ার ঘরে ডলার বৃষ্টি করছে
স্যাণ্ডউইচ আর প্যাসট্রি আর বনবনের উপরে।
খাওয়ার পরে ওরা সহপাঠীদের হৈ-হুল্লোড় পর্যবেক্ষণ করে সিঁড়িতেই বসে বা দাড়িয়ে। কাছে না
গিয়েও মজাটা যোল-আনাই যেন উপভোগ করে তারা। এক এক সময়ে হেসে
গড়িয়ে পড়ে এ-ওর গায়ে।
ছেলে দুটির সম্বন্ধে অনেক কথাই কানে এসেছে মিস কেরীর।
খুবই গরিব ওরা। বাপ মারা গিয়েছে অনেকদিন। আছে এক মা, তারই সঙ্গে সমুদ্রের ধারে একটা কুঁড়েঘরে ওরা থাকে। কী করে
যে মা ওদের খাওয়ায়, তা সেই মা ছাড়া আর কেউ জানে না।
খ্রীষ্টান ওরা, তাতে ভুল নেই। প্রথম যখন এ-পাড়ায় এল ঐ নিগ্রো নারী,
গির্জায় এসেছিল একদিন। রেভারেণ্ড সোয়ানসন, বুড়ো
পাদরী দোরের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ও তাকে বলল “আমরা খ্রীষ্টান, দীক্ষা নিয়েই
খ্রীষ্টান হয়েছি।”
পাদরী হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন ওদের, ভিতরে নিয়ে গেলেন সঙ্গে করে। স্ত্রীলোকটি ইচ্ছে করেই পিছনে
বসল, যাতে তাদের কালো মুখ দেখে অন্য উপাসকেরা বিরক্ত না হয়।
কিন্তু ওর সে-সতর্কতা বৃথা হল। কেমন করে শ্বেতাঙ্গিনী উপাসিকাদের মধ্যে কথাটা জানাজানি হয়ে
গেল যে একটা নিগ্রো মেয়ে এসে তাদেরই সঙ্গে বসে পড়েছে গির্জার ভিতরে। তারপরেই একটি
দুটি করে মেমসাহেবেরা উঠে বেরিয়ে গেলেন গির্জা থেকে দেখতে দেখতে গির্জা খালি। স্যামি-হ্যামির মা কেঁদে বাড়ি ফিরল সেদিন। আর কখনও যায় নি গির্জায়।
গরিব বলেই ওদের উপরে মিস কেরীর সহানুভূতিটি প্রথম পড়েছিল।
ক্রমে তা গভীর হতে লাগল ওদের মধুর ব্যবহারে। ঝগড়া নেই, গোলমাল নেই, গোঁয়ার্তুমি নেই,
সদাই বিনীত, অল্পেই খুশী, একটি সদয় চাউনির বিনিময়ে প্রাণ দিতে রাজী। মিস কেরী ওদের খুবই ভালবেসে ফেললেন
দিনে দিনে।
ওদের সম্বন্ধে একমাত্র নালিশ মিস কেরীর—পড়াশুনায় ওরা একেবারে গবেট। চেষ্টা করে, প্রাণপণে খাটে, কিন্তু তবু কিছুতেই কিছু ওদের মাথায়
ঢোকে না। না ইংরাজী, না অঙ্ক, না ভূগোল,
ইতিহাস। একদিন অনেক কষ্টে মিস কেরী ওদের শেখালেন যে যে-কাজটা একজন লোকে দশ দিনে সমাধা করতে পারে, দুজন লোকে
তা সমাধা করবে পাঁচ দিনে। ব্যাস, পরের দিন তারা আঁক কষে নিয়ে
এল যে একটা জামার দাম যদি দশ ডলার হয়, দুটো জামার দাম হবে পাঁচ
ডলার। বাধ্য হয়ে স্যামি-হ্যামির খাতায় প্রায়ই শূন্য নম্বর
দিতে হয় মিস কেরীকে। ওরই মধ্যে দৈবাৎ যদি কোথাও একটু শুদ্ধ উত্তর তিনি দেখতে পান,
আনন্দে তিনি নিজেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। কী করে যে ওদের প্রশংসা করবেন,
উৎসাহ দেবেন, তা যেন ঠাউরে উঠতেই পারেন না।
এ-স্নেহের প্রতিদানও কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেয় স্যামি-হমি। মিস কেরীকে তারা দেবী জ্ঞান করে বললেই হয়।
স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে যে-সব ছাত্র-ছাত্রী, সর্বনিম্ন ক্লাসের পড়ুয়ারা তাদের বরণ করে নেয় একটা উৎসবের অনুষ্ঠান করে।
মিস কেরীর ক্লাসটাই অবশ্য সর্বনিম্ন। বরণ-উৎসবে তাকে অনেকখানি
দায়িত্বই নিতে হয় ফী-বছর।
উৎসবের আগে একটা পরামর্শসভা বসল। ক্লাসের একজন স্থায়ী
প্রেসিডেন্ট রয়েছে। পড়ুয়াদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটিকেই ঐ পদের জন্য নির্বাচিত
করা হয় বছরের শুরুতে। এবারকার প্রেসিডেন্ট মিকি ফিশার, অতি ক্ষুদে কিন্তু অত্যন্ত রাশভারী এক শিশু।
মিকির সভাপতিত্বে সভার অধিবেশন শুরু হল। মিস কেরী সম্মানিত
পর্যবেক্ষক হিসাবে হাজির আছেন সভায়। বরণ-উৎসবের কর্মসূচী স্থির হল--গান, বাজনা, নাচ, ম্যাজিক, কবিতা, বক্তৃতা, আবৃত্তি,
আরও অনেক অনেক জিনিসই হবে। খুঁটিনাটি বিচার এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার
জন্য গঠিত হল এক প্রোগ্রাম কমিটি, মিস কেরী সাহায্য করবেন এ-কমিটিকে।
প্রকারান্তরে গোটা অনুষ্ঠানটিরই বোঝা শিক্ষিকা মহাশয়ার
উপরে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হল প্রেসিডেন্ট মিকি ফিশার। মিস কেরীর এটা গা-সওয়া আছে, ফী-বছরই
এ-দুর্ভোগ তাঁকে পোয়াতে হয়।
খাওয়াদাওয়া অবশ্যই হবে উৎসবে। তার জন্য প্রতি ছাত্র-ছাত্রীর উপরে চাঁদা ধার্য করা হল পঁচিশ সেন্ট। নামমাত্রই চাঁদা,
মোট খরচা যা হবে, তার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও এ থেকে
উসুল হবে না। তবু পড়ুয়াদের মনে আত্মপ্রসাদ যাতে আসে, তারই জন্য
এই চাদা তোলার ব্যবস্থা। খরচার সিংহভাগটা ইস্কুলই চিরদিন বহন করে।
পঁচিশ সেন্ট চাদা—কিছুই নয়।
সভার কাজ যখন শেষ হতে চলেছে, মিস কেরী উঠে দাঁড়িয়ে পার্লামেন্টের বক্তৃতার ধাঁচে এক ভাষণ
দিলেন-“মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমার উপর
পোগ্রাম কমিটির সহযোগিতা করার ভার দিয়ে আমাকে যে কতখানি সম্মানিত করেছেন এই সভা,
তা ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি আমার নেই। অশেষ ধন্যবাদ এজন্য সভাকে। এবং
সেই সঙ্গে সভার কাছে আমার দুটি ছোট্ট নিবেদন।
“প্রোগ্রাম কমিটির যাঁরা কর্মী নির্বাচিত হয়েছেন, তারা সবাই দক্ষ লোক। তবু, কাজ অনেক করতে
হবে, ওঁদের ঐ কয়টির পক্ষে সব কাজ হয়ত সুনির্বাহ করা সহজ হবে
না। তাই একটা ব্যবস্থা থাকুক এইরকম যে প্রয়োজন বোধ করলে প্রোগ্রাম কমিটির সহকারিণী
হিসাবে আমি ইচ্ছামত আরও দুই-চারজন কর্মীকে ঐ কমিটির অতিরিক্ত
কর্মী হিসাবে গ্রহণ করতে পারব।
“দ্বিতীয় কথা এই যে, পচিশ সেন্ট চাদাটা
সত্যিই এমন-কিছু বেশী চাদা নয় যদিও, তবুও
দৈবাৎ এমন পরিস্থিতিও কারও ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে যেখানে পঁচিশ সেন্টও সাময়িকভাবে
হাতের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না। সেরকম ক্ষেত্রে “অর্থাৎ সংক্ষেপে এইটুকুই আমি বলে রাখছি যে সেরকম অবস্থা কারও হলে সে যেন গোপনে
আমার কাছে আসে, আমি যা-হোক করে ঐ পঁচিশ সেন্টের একটা ব্যবস্থা সাময়িকভাবে করে দেব---”
সহকারিণী মিস কেরীর এ-দুটো প্রস্তাবের একটাতেও সভার আপত্তি করার কিছু ছিল না। সভা
তলিয়েও দেখল না যে দুই-দুটো প্রস্তাবের লক্ষ্য একজোড়া মাত্র
বালক কালো-চামড়া স্যামি আর হ্যামি।
কয়েকদিন বাদেই, স্কুলের পরে মিস কেরীর অফিসঘরে কাচুমাচুভাবে পাশের দিকে হাঁটতে হাঁটতে স্যামুয়েল-হ্যামুয়েলের আবির্ভাব---”
‘কী গো, স্যামি-হ্যামি, খবর কী? আমি তো
তোমাদের কথাই ভাবছিলাম। খানিকটা খেটেখুটে দিতে হবে বাবা, এই উৎসবে।
আমি তোমাদের নাম লিখে নিয়েছি, অতিরিক্ত কর্মী হিসাবে---”
আসন্ন উৎসবের প্রকৃতি বিশ্লেষণ ও প্রস্তাবিত কর্মসূচী
বর্ণনা করে চার পৃষ্ঠার বই ছাপা হয়েছে। একখানা, তাতে স্যামি-হ্যামির নামও যে আছে, তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন মিস কেরী।
স্যামি আর হ্যামি?
তারা তো বিশ্বাসই করতে পারে না নিজেদের চোখকে। তাদের
নাম? ছাপার হরফে ? আকাশে নক্ষত্র সাজিয়ে সাজিয়ে ফেরেশতা গেব্রিয়েল (জিব্রাইল আ.) যদি তাদের
নাম লিখে ফেলতেন সেখানে, এর চেয়ে বেশী আশ্চর্য তাতেও তারা হতে
পারত না।
কিন্তু তারা এসেছে অন্য কারণে। অন্য কথা নিয়ে। তারা গান গাইতে জানে, প্রোগ্রামে নাম তুলতে হবে তাদের।
মিস কেরীর কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে মানুষকে শোনাবার
মত গান ওরা সত্যিই গাইতে পারবো, তবু ওদের
প্রত্যাখ্যান করতেও মন চায় না তার। এতখানি আগ্রহ ওদের। বিমুখ করলে বড়ই ব্যথা পাবে!
ভাববে—কালো চামড়ার দরুনই ওরা বাদ পড়ে
গেল প্রোগ্রাম থেকে।
আর দেখতে গেলে, অন্য যে-সব শিশু-শিল্পী নাচবে গাইবে,
তারাও কিছু জনে জনে প্যাভলোভা১ বা রবসন১ নয়।
কেলেঙ্করি সবাই করবে, তাতে সন্দেহ নেই। শিশুমেলায় সেই কেলেঙ্কারিটাই তো উপভোগ্য!
কেলেঙ্কারি সবাই যখন করবে, তখন স্যামি-হ্যামিও নাহয় করল!
তিনি গীটারে আর গানে নাম লিখে নিলেন ওদের।
তারপর ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ
সেন্ট বার করলেন--“এই হল তোমাদের দুজনের চাঁদা। আমি এখন
দিয়ে দিচ্ছি, তোমরা বড় হয়ে আমায় ফিরিয়ে
দিও—কেমন?”
দুখানা কালো মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায় মুখ নীচু করে
রইল ওরা কিছুক্ষণ, তারপর স্যামি বলল-“বড় হওয়া পর্যন্ত সবুর করতে হবে না, পঞ্চাশ সেন্টের মত মেহনত আমরা এখনও করতে পারি। আপনার বাড়ির লাগোয়া যে জমিটা
আছে, ঐটা কুপিয়ে বাগান করে দেব আমরা এই পঞ্চাশ সেন্টের দরুন।
এতে যদি আপনি রাজী থাকেন, তবেই আমরা ধার নেব।”
মিস কেরী চমৎকৃত বেশী হলেন, না মর্মাহত বেশী হলেন, তা তিনি নিজেই
বুঝে উঠতে পারলেন না। বাধ্য হয়েই তাকে রাজী হতে হল ওদের বন্দোবস্তে।
উৎসবের দিন----
ক্ষুদে ক্ষুদে ছাত্রীরা সেজে এসেছে তরুণীর সাজে। ক্ষুদে
ক্ষুদে ছাত্রেরা বেশভূষা করে এসেছে যুবাপুরুষের মত। অভিভাবকেরা বসেছেন দর্শকের আসনে।
উপর ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা ভিড় করে
দাঁড়িয়েছে চারিপাশে। মিস কেরী অন্য সব শিক্ষিকাদের নিয়ে একবার খোশামোদ করছেন ক্ষুদে
ছাত্রীদের, আর একবার খোশামোদ করছেন ক্ষুদে ছাত্রদের। খোশামোদ-তাদের নাচে নামাবার জন্য। লজ্জা তাদের কিছুতেই ভাঙে না।
কিন্তু ভাঙল যখন, তখন তাদের নাচ থামানোও হল আর এক সমস্যা। কিছুতেই কি তারা ক্ষান্ত হয়!
নাচছে তো নেচেই যাচ্ছে
সে-আসরে সত্যি উপভোগ্য হল একটাই জিনিস। স্যামি-হ্যামির গান।
ঐ রোগা কুশ্রী নিগ্রো বালক দুটো সত্যিই গাইতে জানে বটে! কে তাদের
শেখাল? কেউ না। ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা ওদের। সব দিক দিয়ে বঞ্চিত
করেও ঈস্বর একটি মাত্র দাক্ষিণ্যে (পুরস্কার) ওদের সব ক্ষতি পূরণ করে দিয়েছেন।
সেইদিন থেকে স্কুল স্বর্গে পরিণত হল স্যামি-হ্যামির পক্ষে। সাদা ছেলেরা যেচে এসে খাতির জমাতে লাগল ওদের
সাথে। এরা যে অন্ততঃ একটা দিক দিয়েও তাদের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ, এটা তারা মেনে নিয়েছে, শ্রেষ্ঠত্বের ন্যায্য সম্মানও
দিচ্ছে দরাজ হাতে।
স্কুলের পর কিন্তু স্যামি-হ্যামির কাজ দাঁড়িয়েছে এখন মিস কেরীর বাগান, কোপানো। সে কী কোপানো। দিনের পর দিন কোপানোই চলেছে। একগাছা ঘাস কোথাও রইল না, কোথাও যদি মাটির তলায় এতটুকু শিকড়ের সন্ধান তারা পেল,
বিশ হাত মাটি খুঁড়েও তার জড় তুলে ফেলবে তারা। মাটি ধুলো-ধুলো করে তবেই তারা কোপানো ছাড়ল।
দিনের পর দিন কোপানোই চলেছে। তারপর মিস কেরীর কাছে
বীজ চেয়ে নিয়ে কেয়ারি করে করে তারা বীজ বসিয়ে দিল। মিস কেরী রোজই বলেন—“তোরা আর কত মেহনত করবি? পঞ্চাশ সেন্টের
দেনা কি আর। ইহজীবনে শোধ হবে না?” তারা তা শুনে শুধু হাসে—মুখ নীচু করে হাসে।।
![]() |
choto golpo,Bangla translation,story of life,অনুবাদ গল্প,জীবনের গল্প,The Little black boys,বাংলা অনুবাদ |
একদিন সাহিত্য পড়াতে গিয়ে ‘রক গার্ডেন’ কথাটি পেলেন মিস কেরী। বুঝিয়ে দিলেন রক গার্ডেন কাকে বলে।
তার পরের দিন-
কী মর্মান্তিক দুর্ঘটনা! সমুদ্রে নৌকাডুবি হয়ে স্যামি-হ্যামি
মারা গিয়েছে। স্কুলের কাজ কিছুই করতে পারলেন না মিস কেরী। ছুটির পরই ছুটে গেলেন ওদের
কুঁড়েতে। দুটো ছোট্ট কফিন। পড়ে আছে, স্যামি-হ্যামির দেহ ভরে ফেলা হয়েছে তার ভিতর। পাদরী সোয়ানসন বসে আছেন। এক পাশে,
স্যামি-হ্যামির মা আর এক পাশে মেয়েটি পাথর বনে
গিয়েছে যেন।
এর ওর তার কাছ থেকে কথাটা কানে এল মিস কেরীর। ওরা একটা
জেলে-ডিঙ্গি চেয়ে নিয়ে নোনা দ্বীপে গিয়েছিল,
পাথর আর শ্যাওলা নিয়ে আসবার জন্যে। বলেছিল--“গুরু মার (মিস কেরী) বাগানটাকে রক গার্ডেন করব আমরা—”
ফেরার সময়ে একটু ঝড় উঠেছিল। সামান্যই ঝড়, কিন্তু পাথরে পাথরে ডিঙ্গিটা এমন বোঝাই ছিল--অন্য জেলেরা এসে পড়ার আগেই ডুবে গেল ওরা।
মিস কেরী! মিস কেরী! আজ তাদের মায়ের দুঃখ বেশী, না মিস কেরীর দুঃখ বেশী, তা কে বলে দেবে? মিস কেরীর কেবলই মনে হয়- “আমায় কেন তোরা অত ভালবাসতে গেলি বাছাৱা? কেন? কেন?”
টিকাঃ
১। আনা প্যাভলোভা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত নর্তকী, রবসন বিশ্ববিখ্যাত নিগ্রো গায়ক।
No comments:
Post a Comment