![]() |
অনুবাদ গল্প,জীবনের গল্প,বিদেশি গল্প,রোমাঞ্চ গল্প,রোমাঞ্চ উপন্যাস,Koolau the Leper,Bangla translation,Jack London,জ্যাক লন্ডন,কুলাউ দ্যা লিপার |
অনুবাদ গল্প – রোমাঞ্চ গল্প – কুলাউ দ্যা লিপার – জ্যাক লন্ডন - Koolau the Leper - Jack London – Bangla translation
যেহেতু আমরা অসুস্থ তারা কেড়ে নিয়েছে আমাদের
স্বাধীনতা। আমরা আইন মেনেছি। আমরা কোনও অন্যায় করিনি। তবু তারা আমাদের বন্দি করে রেখেছে।
মোলোকাই আসলে একটা কারাগার। তোমাদের সেটা ভাল করেই জানা আছে। তার বোন, নিউলিকে মোলোকাই
পাঠানো হয়েছে সাত বছর আগে। তারপর থেকে বোনের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। দেখা এ-জীবনে
আর হবেও না। মৃত্যু এসে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত মেয়েটি সেখানেই বন্দি থেকে যাবে।
এটা তার ইচ্ছেয় ঘটেনি। এরকম কোনও ইচ্ছে নিউলির ছিল না। এই ইচ্ছে সাদা চামড়ার মানুষের
যারা শাসন করেছে এই দেশ। আর, কারা এই সাদা চামড়ার মানুষ?
‘আমরা জানি। জেনেছি আমাদের বাপদাদার কাছ
থেকে। এসেছে তারা ভেড়ার মত, কথা বলেছে নরম সুরে। তখন নরম সুরেই কথা বলতে হয়েছে তাদের,
কারণ, আমরা যেমন ছিলাম শক্তিশালী তেমনই সংখ্যায়ও তাদের চেয়ে অনেক বেশি, আর সবগুলো
দ্বীপই ছিল আমাদের। আগেই বলেছি, কথা বলত তারা নরম সুরে। তারা ছিল দুই জাতের। একটা আমাদের
অনুমতি প্রার্থনা করত, সদয় অনুমতি, যেন আমাদের মাঝে তারা প্রচার করতে পারে ঈশ্বরের
বাণী। আরেকটা প্রার্থনা করেছে আমাদের অনুমতি, সদয় অনুমতি, যেন ব্যবসা করতে পারে আমাদের
সঙ্গে। সে-ই ছিল শুরু। আজ সবগুলো দ্বীপ তাদের, পুরো দেশ, সমস্ত গবাদিপশু-যাবতীয় কিছু
তাদের দখলে। যে-দল প্রচার করত ঈশ্বরের বাণী আর যে-দল করত ব্যবসা, কীভাবে হঠাৎ করে যেন
মিলিত হলো তারা আর তারপর হলো বড় বড় সব দলপতি। অনেক কক্ষবিশিষ্ট বাড়িতে বাস করতে
লাগল তারা রাজার মত, তাদের সেবা-যত্নে নিয়োজিত হলো অসংখ্য ভৃত্য। একদিন যাদের কিছুই
ছিল না, আজ তারাই পেয়ে গেছে সব, আর যদি তুমি, বা আমি, কিংবা আমাদের যে-কেউ অনাহারে
থাকে, তারা দাঁত খিচিয়ে বলে, তোমরা কোনও কাজ করো না কেন? ওই তো রয়েছে কত আবাদী জমি।’
কুলাউ একটু থামল। একটা হাত তুলল সে, তারপর গাঁটওয়ালা
কুঁকড়ে যাওয়া আঙুলে ওপরে তুলে ধরল তার মাথার কালো চুলে প্যাচানো হিবিসকাসের ঝলমলে
মালা। চারপাশ ভেসে যাচ্ছে জোছনার রূপালি বন্যায়। এই রাত এক শান্তির রাত, যদিও তাকে
ঘিরে যারা কথা শুনছিল তাদের সবাই যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত। মুখ তাদের সিংহের মত। কারও মুখে
বিরাট এক গর্ত যেখানে নাক ছিল একদা, আবার কারও কেবল বাহুটাই আছে, পচে খসে পড়েছে হাত।
বসে আছে জনা তিরিশেক পুরুষ আর মহিলা, ফ্যাকাসের চেয়েও অনেক বেশি ফ্যাকাশে, তাদের মানুষসুলভ
চেহারায় এখন ফুটে উঠেছে জান্তবর্গ।
বসে রইল তারা ফুলের মালা পরে, উজ্জ্বল, সুগন্ধীভরা
রাতে, ঠোটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল তাদের অদ্ভুত সব শব্দ, কুলাউ এর বক্তব্যে সমর্থন
জোগাল খসখসে গলা। একদা তারা ছিল নারী আর পুরুষ। কিন্তু এখন তারা আর নারীও নয় পুরুষও
নয়। এখন তারা দানব-চেহারা আর আকার মিলিয়ে মানুষের এক ভয়াবহ রসিকতা। বীভৎস ধরনের
অঙ্গহানি তাদের চেহারায় এনে দিয়েছে এমন বিকৃতি যেন তারা নরকভোগ করেছে লক্ষ লক্ষ বছর
ধরে। তাদের হাতগুলো হয়েছে এখন নখরের মত। মুখের দিকে তাকালে মনে হবে, জীবন যেন তাদের
নিয়ে খেলেছে ভয়াবহ এক খেলা। এক মহিলার তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক-জাগানো দুই
গর্ত দিয়ে, যেখানে একদা ছিল তার সুন্দর একজোড়া চোখ! কেউ কেউ ভোগ করছে ব্যথা, গোঙানি
বেরিয়ে আসছে তাদের বুকের গভীর থেকে। কেউ কেউ কাশছে, মাংসপেশির কোষ ছিড়ে যাওয়ার শব্দ
তুলে। দু’জন আবার এমন হয়ে গেছে
যেন মানুষ নয় তারা, বিশালাকৃতির দুই বানর, সোনালি ফুলের মালা মাথায় জড়িয়ে তারা
দুর্বোধ্য সব শব্দ করছে। একজনের কানের লতি কাঁধের ওপর ঝুলে পড়ে পাখার মত দুলছে একপাশ
থেকে আরেক পাশে।
আর এখানে কুলাউ হলো রাজা। এটাই তার রাজ্য-ফুলে
ঠাসা এক গিরিসঙ্কট, যেটাকে ঘিরে উঠে গেছে আরোহণের প্রায় অসাধ্য সটান খাড়া পাথুরে
ঢাল যার আনাচ-কানাচ থেকে মাঝেসাঝেই ভেসে আসে বুনো ছাগলের ডাক। তিন পাশ ঘেরা এই পাথুরে
ঢালের ফাঁকে ফোকরে রয়েছে গুহা যার ভেতরে বাস করে কুলাউ-এর প্রজারা। চতুর্থ পাশটা যেন
নেমে গেছে অতল এক গর্তে যেখানে দেখা যায় অপেক্ষাকৃত নিচু সব পাহাড়ের চূড়া আর ঢাল,
যার পাদদেশে গুমগুম শব্দে আচ্ছড়ে পড়ে ফেনা সৃষ্টি করছে প্রশান্ত মহাসাগর। ভাল আবহাওয়ায়
নৌকা ভিড়তে পারে কালালাউ উপত্যকার প্রবেশমুখের এই পাথুরে সৈকতে, তবে আবহাওয়া থাকতে
হবে খুবই ভাল। ঠাণ্ডা মাথার কোনও পর্বতারোহী সৈকত থেকে উঠে আসতে পারে কুলাউ-এর এই রাজ্যে;
কিন্তু সেই পর্বতারোহীর মাথা থাকতে হবে খুব ঠাণ্ডা, আর বুনো ছাগলদের যাতায়াতের পথ
অবশ্যই তার নখদর্পণে থাকতে হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কুলাউ-এর ভাঙাচোরা, বিকৃত চেহারার
প্রজারা বুনো ছাগলের পথ ধরে প্রায় অনায়াসেই উঠে আসতে পারে চূড়ান্ত দুর্গম এই রাজ্যে।
‘ভাইসব,’ বলতে শুরু করল কুলাউ।।
কিন্তু এই সময় বানরাকৃতি সেই মানুষদের একজন
ছাড়ল উন্মাদসুলভ এক তীক্ষ্ণ চিৎকার, আর কুলাউ অপেক্ষা করে রইল যতক্ষণ না চিৎকারটা
পাথুরে দেয়ালগুলোতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে যায় নিস্পন্দ রাতের গহ্বরে।
‘ভাইসব, ব্যাপারটা কি
অদ্ভুত নয়? এই দেশ ছিল আমাদের, অথচ এখন এই দেশ আর আমাদের নেই। ঈশ্বরের বাণী প্রচারকারী
ভন্ডরা আর সেই ব্যবসায়ীরা দেশের পরিবর্তে আমাদের কী দিয়েছে? তোমাদের কেউই কি এই দেশের
পরিবর্তে এক ডলার, মাত্র একটা ডলারও পেয়েছ? তবু এই দেশ তাদের, আর তার পরিবর্তে তারা
বলতে পারে যে আমরা চাইলে খেতে কাজ করতে পারি, তাদের খেতে, এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও
আমরা সেখানে যা-ই ফলাই না কেন সেই ফসল হবে তাদের। ভেবে দেখো সেই পুরানো দিনগুলোর কথা,
তখন আমাদের কোনও কাজ করতে হত না। আমরা যখন রুগ্ন হয়ে পড়লাম, তারা কেড়ে নিল আমাদের
স্বাধীনতা।
‘এই রোগ এখানে কে আনল,
কুলাউ?’
জানতে
চাইল কিলোলিয়ানা, হালকা-পাতলা একজন মানুষ যার মুখে এমনই এক হরিণশাবকের মত হাসি যে
কেউ এটা আশা করতে পারে, তার পায়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে হরিণের মত চেরা খুর। হ্যাঁ,
পা চেরা তার ঠিকই, কিন্তু তা খুরের কারনে নয়, সে-চেরার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষত পঁচে গিয়ে।
তবু এটাই কিলোলিয়ানা, দলের সবচেয়ে দুঃসাহসী পর্বতারোহী, বুনো ছাগলের যাতায়াতের প্রত্যেকটা
পথ যার নখদর্পণে, কুলাউ আর তার বিকৃত চেহারার অনুসারীদের পথ দেখিয়ে যে অনায়াসে নিয়ে
যেতে পারে কালালাউয়ের যে-কোনও খাজে।
‘ভাল প্রশ্ন করেছ,’ জবাব দিল কুলাউ। কারণ,
আমরা কাজ করব না মাইল কে মাইলব্যাপী আখ খেতগুলোতে যেখানে একদা শান্তিতে চরে বেড়িয়েছে
আমাদের ঘোড়া, আর তা টের পেয়েই সাগরপার থেকে এনেছে তারা চীনা ক্রীতদাস। এবং চীনা সেই
ক্রীতদাসদের সঙ্গেই এখানে এসেছে বিশ্রী এই চীনা রোগ-যে রোগে ভুগছি আমরা আর যে-রোগের
কারণে তারা আমাদের বন্দি করতে চায় মোলোকাই-এ। জন্মেছি আমরা কাউয়াই-এ। অন্য দ্বীপগুলোতেও
ছিলাম আমরা, কেউ এখানে কেউ সেখানে, ওয়াহুতে, মাউই-এ, হাওয়াই-এ, হনলুলুতে। কিন্তু
যেখানেই থাকি না কেন বারবার আমরা ফিরে এসেছি কাউয়াই-এ। কেন ফিরে এসেছি আমরা? নিশ্চয়
তার পেছনে একটা কারণ রয়েছে। কারণটা হলো, কাউয়াইকে আমরা ভালবাসি। এখানেই জন্মেছি আমরা।
বাস করেছি এখানে। গায়ে মেখেছি এখানকার আলো বাতাস। আর তাই, এখানেই আমরা মরব-যদি না-যদি
-আমাদের মাঝে থাকে দুর্বল মনের কেউ। এসব ভীতুদের
আমরা চাই না। তারা মোলোকাই কারাগারেরই উপযুক্ত। আর আমাদের মাঝে যদি সত্যিই ভীতু থাকে,
আমাদের সঙ্গে তাদের না থাকাই ভাল। আগামীকাল সেনারা নামবে সৈকতে ভীতুরা পাহাড় থেকে
নেমে চলে যাক তাদের কাছে। সেনারা দ্রুত তাদের পাঠিয়ে দেবে মোলোকাই-এ। আমরা এখানে থাকব,
এবং লড়াই করব। কিন্তু আমরা মরব না, জানি। আমাদের আছে রাইফেল। তোমরা জানো, এখানকার
দুর্গম পথ এতই সরু যে সেখানে পাশাপাশি দু’জন মানুষ আসার কোনও
উপায় নেই, আসতে হবে একজনের পেছনে আরেকজন, হামাগুড়ি দিয়ে, আর আমি কুলাউ, একদা যে
ছিল নিহাউ-এর এক রাখাল, সরু সেই পথে একাই মোকাবিলা করতে পারি একহাজার সেনাকে। আর এই
যে কাপাহেই, একদা যে ছিল বিচারক, আজ তাকে খোঁজা হচ্ছে। ইঁদুরের মত, ঠিক যেমন খোঁজা
হচ্ছে আমাকে আর তোমাদের। সবাই শোনো তার কথা। সে জ্ঞানী মানুষ।’
কাপাহেই উঠে দাঁড়াল। একদা সে ছিল বিচারক। পড়াশোনা
করেছে পুনাহুর কলেজে। পাশাপাশি বসে পানাহার করেছে। ধর্মপ্রচারক আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থ
রক্ষাকারী জমিদার, দলপতি আর বিদেশি শক্তির উচ্চ ক্ষমতাসীন প্রতিনিধিদের সঙ্গে। হ্যাঁ,
এমনই ছিল কাপাহেই। কিন্তু আজ সে যেন সত্যিই শিকারীর তাড়া খাওয়া এক ইঁদুর, মানবিক
আতঙ্কের পঙ্কিল গর্তে এতটাই নিমজ্জিত যে একইসঙ্গে সে এখন উঠে গেছে আইনের ঊর্ধ্বে এবং
তলিয়ে গেছে আইনের নিম্নে। মুখ জুড়ে পচনে সৃষ্ট ছোট ছোট গর্ত ও ভ্র এবং পাতাবিহীন
চোখের গনগনে দৃষ্টি ছাড়া তার চেহারা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
‘আমাদের ঝামেলা না করাই
ভাল, শুরু করল সে। আমরা একা একা থাকতে চেয়েছি। কিন্তু যদি তারা আমাদের একা থাকতে না
দেয়, তা হলে ঝামেলা সৃষ্টির দায় নিয়ে তাদের ভোগ করতে হবে শাস্তি। তোমরা দেখেছ, আঙুল
আর নেই আমার। সবাইকে দেখাবার জন্যে ওপরে তুলল সে তার আঙুলবিহীন হাতটা। তবু এখনও রয়ে
গেছে আমার বুড়ো আঙুলের একটা গাঁট যা পুরানো দিনের মত আজও টানতে পারে রাইফেলের ট্রিগার।
আমরা কাউয়াইকে ভালবাসি। এখানেই আমরা বরং বাস করব, আর এখানেই মরব, কিন্তু নিজেদেরকে
বন্দি হতে দেব না মোলোকাই-এ। এই রোগ আমাদের নয়। আমরা কোনও পাপ করিনি। ঈশ্বরের বাণী
প্রচারক আর ব্যবসায়ীরা এনেছে এই রোগ, তাদের কুলি ক্রীতদাসগুলোর মাধ্যমে আমি বিচারক
ছিলাম। আইন আর বিচার আমার বেশ ভালভাবেই জানা আছে, আর তাই তোমাদের বলতে চাই যে, একজন
মানুষের দেশ চুরি করা, তাকে চীনা রোগে রোগগ্রস্ত করা, আর তারপর তাকে যাবজ্জীবন কারাগারে
বন্দি করা অন্যায়।
‘ছোট্ট এই জীবন, আর দিনগুলো
যন্ত্রণায় ভরা,’ বলল কুলাউ। ‘এসো সবাই পান করে আর
নেচে যথাসাধ্য সুখী হবার চেষ্টা করি।’
পাথুরে একটা গুহা থেকে লাউয়ের খোলা বের করে
দেয়া হলো সবাইকে। লাউয়ের খোলাগুলো টাই লতা (Ti) থেকে চোলাই করা তীব্র পানিয়তে ভরা।
খানিক পর তরল সেই আগুন যখন তাদের স্নায়ু বেয়ে পৌছে গেল মগজে, এখন যে তারা আর পুরুষও
নয় নারীও নয় সে-কথা ভুলে আবার যেন তারা হয়ে গেল স্বাভাবিক পুরুষ আর নারী। যে-মহিলাটির
শূন্য কোটর বেয়ে নামছিল তপ্ত অশ্রু, আবার তার ধমনিতে ধমনিতে সঞ্চারিত হলো উত্তেজক
জীবন, একটা হাওয়াইয়ান গিটারের তারে ঝঙ্কার তুলে কণ্ঠ চিরে বের করল সে এমন এক বর্বর
ভালবাসার সুর যেমনটা হয়তো একমাত্র শোনা যেত আদিম পৃথিবীর অরণ্য-গহীনে। সুর তার ভেসে
বেড়াল বাতাসে ভর করে, মৃদু উদ্ধত সেই সুরে বিপথে যাবার প্রলোভন। একটা মাদুরের ওপর,
মহিলার গানের তালে তালে নাচতে লাগল কিলোলিয়ানা। নাচে তার মনোভাবের সন্দেহাতীত প্রকাশ।
তার নাচের প্রতিটি ছন্দে ছন্দ তুলেছে ভালবাসা, আর তার পাশেই মাদুরের ওপর নেচে চলেছে
এক মহিলা যার ভারী নিতম্বে ফুটেছে রোগ-ক্ষয়িষ্ণু মুখের বিপরীত এক কাহিনি। এই নাচ জীবস্মৃতদের
নাঁচ, কারণ, তাদের বিকৃত শরীরের গভীরে এখনও লালিত হচ্ছে জীবন ও আকুলতা। শূন্য কোটর
থেকে তপ্ত অশ্রু ঝরানো মহিলা গেয়েই চলল তার ভালবাসার গান, উষ্ণ রাতে সর্তক-নর্তকীরা
নেচেই চলল তাদের ভালবাসার নাচ, যতক্ষণ না লাউয়ের খোলা হাতবদল হতে হতে তাদের সবার মগজে
হামাগুড়ি দিতে লাগল স্মৃতি আর কামনা। মাদুরের ওপর নাচতে থাকা মহিলার পাশাপাশি নাচল
হালকা-পাতলা এক কুমারী, সুন্দর মুখ তার সম্পূর্ণ অবিকৃত, কিন্তু ওঠানামা করা বাহুতে
রোগের ধ্বংসলীলা। আর দুর্বোধ্য শব্দ তোলা বানরাকৃতির দু’জন নাচল আলাদা আলাদা;
অদ্ভুত, উদ্ভট সে-নাচে ভালবাসার হাস্যকর অনুকরণ।
কিন্তু মহিলার ভালবাসার গান থেমে গেল মাঝপথে,
লাউয়ের খোলা নামাল পানকারীরা, বন্ধ হলে নাচ, সবার চোখ এখন নীচের সাগরের দিকে যেখানে
এইমাত্র চন্দ্রালোকে গা ভাসিয়ে ওপরে উঠে গেছে একটা রকেটের নিস্তেজ আলো।
‘সেনারা এসে গেছে, বলল
কুলাউ। আগামীকাল লড়াই হবে। আমাদের এখন ভালভাবে ঘুমিয়ে প্রস্তুতি নেয়া উচিত।’
কুষ্ঠরোগীরা তার আদেশ মেনে হামাগুড়ি দিয়ে চলে
গেল তাদের নিজ নিজ আশ্রয়ে। জোছনায় বসে রইল কেবল নিশ্চল কুলাউ, হাঁটুর ওপরে তার আড়াআড়িভাবে
রাখা রাইফেল, দৃষ্টি অনেক নীচের সৈকতে নোঙর করা নৌকাগুলোর ওপর।
আশ্রয় হিসেবে কালালাউ উপত্যকার শেষ প্রান্ত
নির্বাচন করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। খাড়া পাথুরে দেয়ালের ওপর দিয়ে পেছনে যাবার
পথটা একমাত্র কিলোলিয়ানার চেনা থাকার ফলে সে ছাড়া যে-কোনও মানুষ কুষ্ঠরোগীদের গিরিসঙ্কটে
পৌছুতে চাইলে তার প্রায় ক্ষুরধার একটা শৈলশিরা ধরে আসা ছাড়া উপায় নেই। পথটা বড়জোর
বারো ইঞ্চি চওড়া। দু’পাশেই মুখ ব্যাদান করে আছে অতল খাদ। একবার পা
হড়কালেই, সোজা সে-মানুষ নেমে যাবে ডান বা বামপাশে মৃত্যুগহ্বরে। কিন্তু কোনওমতে পথটা
পেরোলেই নিজেকে সে দেখতে পাবে পার্থিব এক স্বর্গে। পুরো জায়গাটা জুড়ে যেন এক গাছপালার
সাগর; সবুজে মোড়া পাথুরে দেয়ালগুলো ঝুলে আছে রাশি রাশি আঙুরলতা, খাঁজে খাঁজে উঁকি
মারছে অজস্র জাতের ফার্ন। কুলাউ-এর শাসনকাল শুরু হবার পর মাসের পর মাস অনুসারীদের নিয়ে
তাকে লড়াই করতে হয়েছে সবুজ এই সাগরের সঙ্গে। শ্বাসরোধী জঙ্গলকে বারবার পিছু হটিয়ে
দিতে হয়েছে সেগুলোর কবল থেকে বুনো কলা, কমলা আর আমকে রক্ষা করার খাতিরে। কিছু কিছু
ফাকা জায়গায় জন্মেছে বুনো অ্যারারুট, টারো আর তরমুজ; এসব ছাড়া যেখানেই প্রবেশ করতে
পেরেছে সূর্যালোক সেখানেই সোনালি ফলভারে নুয়ে পড়ছে বুনো পেঁপের অসংখ্য গাছ।
কুলাউকে এই আশ্রয়ে তাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে
সৈকতের পাশের নিচু উপত্যকা থেকে। এখান থেকেও যদি বারবার তাড়া খায় তা হলেও কোনও অসুবিধে
নেই, জড়াজড়ি করে থাকা অসংখ্য পর্বতচুড়োর ফাঁকফোকরের গিরিসঙ্কটগুলো চেনা আছে তার,
প্রজাদের সেখানে নিয়ে গিয়ে শুরু করতে পারবে সে নতুন করে বসবাস। এখন রাইফেল পাশে নিয়ে
বসে আছে সে, লতাপাতার ফাঁক দিয়ে লক্ষ করছে সৈকতের ওপর সেনাদের গতিবিধি। সঙ্গে করে
কামান এনেছে তারা, আয়নার মত সেগুলোর গা থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যালোক। ক্ষুরধার
শৈলশিরাটা ঠিক তার সামনে। সেখানে পৌছাবার পথ ধরে এগিয়ে আসছে খুদে ক’জন মানুষ। সে জানে,
ওই যে অনেক দূর থেকে এগিয়ে আসছে, তারা সেনা নয়, পুলিশ। তারা ব্যর্থ হলেই কেবল মাঠে
নামবে সেনারা।
বাঁকা একটা হাত রাইফেলের নলের ওপর বোলাল সে আদরের
ভঙ্গিতে, নিশ্চিত হয়ে নিল যে সাইট একদম পরিষ্কার আছে। নিহাউ থাকতেই গুলি করা শিখেছে
সে, দ্বীপটার কেউই তার অব্যর্থ নিশানার কথা ভোলেনি। যতই এগোল, খুদে থেকে ধীরে-ধীরে
বড় হতে লাগল মানুষগুলো সে পাল্লা মাপল মনে মনে, বিবেচনা করল বয়ে যাওয়া তীব্র বাতাসের
কথা, ভাবল লক্ষ্যবস্তু অনেকখানি নীচে থাকায় ওপর দিয়ে গুলি করার সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু
সে গুলি করল না। তারা পথটার মুখে না আসা পর্যন্ত সে জানতে দিল না তার উপস্থিতি, তারপর
নিজেকে প্রকাশ না করেই কথা বলল ঝোপের ভেতর থেকে।
‘তোমরা কী চাও?’ জানতে চাইল সে।
‘আমরা কুষ্ঠরোগী কুলাউকে
চাই,’ জবাব দিল স্থানীয়
পুলিশদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা নীলচোখে এক আমেরিকান।
‘এক্ষুনি ফিরে যাও,’ বলল কুলাউ।।
লোকটাকে সে চেনে, ডেপুটি শেরিফ, তার তাড়া খেয়েই
নিহাউ থেকে এসেছে সে কালালাউ উপত্যকায়, তারপর উপত্যকা থেকে এই গিরিসঙ্কটে।
‘তুমি কে?’ জানতে চাইল শেরিফ।
‘আমিই কুষ্ঠরোগী কুলাউ,’ জবাব ভেসে এল।
‘তা হলে আড়াল ছেড়ে
বেরিয়ে এসো। আমরা তোমার সন্ধানেই এসেছি। জীবিত বা মৃত, তোমার মাথার মূল্য ধরা হয়েছে
একহাজার ডলার। তুমি পালাতে পারবে না।’
ঝোপের ভেতর থেকে জোরে হেসে উঠল কুলাউ।
‘বেরিয়ে এসো!’ আদেশ দিল শেরিফ, কিন্তু
সে আদেশের জবাব দিল না কেউ।
শেরিফকে পুলিশদের সঙ্গে পরামর্শ করতে দেখে কুলাউ
বুঝতে পারল, তারা একযোগে তার দিকে ছুটে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
‘কুলাউ,’ গলা চড়াল শেরিফ। ‘কুলাউ, আমি তোমাকে ধরতে
আসছি।’
‘তা হলে আগে সূর্য, সাগর
আর আকাশ ভালভাবে দেখে নাও, কারণ, ওগুলো দেখার সুযোগ তুমি আর পাবে না।’
‘ঠিক আছে, কুলাউ,’ বলল শেরিফ নরম সুরে।
‘আমি জানি তোমার নিশানা
অব্যর্থ। কিন্তু তুমি আমাকে গুলি করবে না। আমি কখনওই তোমার কাছে অন্যায় করিনি,’ঝোপের মধ্যে ঘোত করে
উঠল কুলাউ।
‘বলছিলাম, আমি কখনওই
তোমার কাছে অন্যায় করিনি, করেছি বলো?’ শেরিফের স্বরে নাছোড়বান্দার
ভাব।
‘প্রথম অন্যায় করেছ
তুমি আমাকে বন্দি করতে চেয়ে,’ জবাব এল এবার। ‘দ্বিতীয় অন্যায় করেছ
আমার মাথার জন্যে ঘোষিত একহাজার ডলার বাগাবার চেষ্টা করে। যদি বাঁচতে চাও, যেখানে আছ
সেখানেই থাকো।’
‘তোমাকে ধরার জন্য আমাকে
এগোতেই হবে। আমি দুঃখিত। এটা আমার কর্তব্য।’
‘পা বাড়ানো মাত্র মারা
যাবে তুমি।’
শেরিফ কাপুরুষ নয়। তবু সে সিদ্ধান্ত নিতে পারল
না। তাকাল সে দু’পাশের মুখ ব্যাদান করে থাকা অতল খাদের দিকে,
ক্ষুরধার পথটার ওপরও তার দৃষ্টি ঘুরে এল একবার-ওই পথটা যে তাকে পেরোতেই হবে। তারপর
সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।
‘কুলাউ,’ হাঁক ছাড়ল সে। কিন্তু
নীরব হয়ে রইল ঝোপ। ‘কুলাউ, গুলি কোরো না। আমি আসছি।’
পেছন ফিরে পুলিশদের কিছু আদেশ দিল শেরিফ, তারপর
এগোতে লাগল সেই ভয়ঙ্কর পথ ধরে। গতি বাড়ানোর কোনও উপায় নেই। এটা যেন সার্কাসের দড়ির
ওপর দিয়ে হাঁটা। ভর দেয়ার জন্যে এখানে রয়েছে শুধুই বাতাস। তার পায়ের নীচে মড়মড়
করে উঠল লাভার পাথর, ভেঙে যাওয়া টুকরোগুলো নেমে গেল দু’পাশের খাদে। সূর্যের
খাড়া তাপে তার মুখ থেকে দরদর করে ঝরতে লাগল ঘাম। তবু তিলতিল করে এগিয়ে এসে সে দাড়াল
মাঝ বরাবর।।
‘থামো!’ ঝোপ থেকে ভেসে এল কুলাউ-এর
আদেশ। ‘আর একটা ধাপ এগোবার
সঙ্গে সঙ্গে আমি গুলি করব।’
থামল শেরিফ, দুলতে লাগল অত্যন্ত সরু সেই পথে
ভারসাম্য রক্ষার খাতিরে। মুখ তার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, তবে চোখজোড়ায় কঠিন সঙ্কল্পের
চিহ্ন। কথা বলার আগে চেটে শুকনো ঠোট ভেজাল সে।
‘কুলাউ, তুমি আমাকে গুলি
করবে না। জানি, তুমি আমাকে গুলি করবে না।’
আবার এগোতে লাগল সে। সঙ্গে সঙ্গে কান ঘেঁষে ছুটে
যাওয়া বুলেট ঘোরাল তাকে আধ পাক। মুখে ফুটে উঠল নালিশ মেশানো একটা বিস্ময়। নিজেকে
রক্ষার শেষ একটা চেষ্টা করল সে, পরক্ষণেই তার চোখের সামনে এসে দাঁড়াল মৃত্যু। এবার
শূন্য ক্ষুরধার পথ ধরে তেড়ে এল পাঁচ পুলিশ। একইসঙ্গে বাহিনীর বাকি পুলিশেরা গুলি ছুঁড়তে
লাগল ঝোপ লক্ষ্য করে। পাঁচ বার ট্রিগার টানল কুলাউ, এত দ্রুত যে পাঁচটা গুলি তুলল সম্মিলিত
একটা ঝনঝন শব্দ। চোখের পলকে বার বার স্থান পরিবর্তন করে ব্যর্থ করে দিল সে পুলিশদের
প্রত্যেকটা গুলি। মাথার ওপর দিয়ে বেশকিছু বুলেট সাঁ সাঁ করে ছুটে যাবার পর উঁকি দিল
সাবধানে। চারটে পুলিশ শেরিফকে অনুসরণ করে হারিয়ে গেছে অতল খাদে। পঞ্চম পুলিশটা পড়ে
আছে ক্ষুরধার সরু পথটার উপর, এখনও জীবিত। ইতিমধ্যেই গুলি বন্ধ করে দিয়েছে পথের ওপাশের
পুলিশেরা। আড়ালহীন এই পাথুরে অঞ্চলে তাদের এগোবার আর কোনও আশা নেই। তারা নেমে যাবার
আগে কুলাউ অনায়াসেই খতম করে দিতে পারত পঞ্চম পুলিশটাকে। কিন্তু সে গুলি করল না, আর,
নিজেদের মাঝে আলোচনা সেরে নিয়ে, একজন সাদা আণ্ডারশার্ট খুলে দোলাতে লাগল পতাকার মত,
তারপর সারি বেঁধে গিয়ে সাড়াল তাদের আহত সঙ্গীর কাছে। কুলাউ কোনও জবাব দিল না, তবে
তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের চলে যেতে দেখল নীচের উপত্যকার দিকে। দু’ঘণ্টা পর, আরেক ঝোপের
ভেতর থেকে কুলাউ লক্ষ করল, উপত্যকার উল্টো পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসছে পুলিশের
আরেকটা বাহিনী। সে দেখল, যতই তারা ওপরে উঠল, তাদের সামনে দিয়ে ছুটে ছুটে পালিয়ে গেল
বুনো ছাগলের দল। শেষমেশ নিজের বিচারবুদ্ধির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, সে ডেকে পাঠাল
কিলোলিয়ানাকে।
‘না, এখানে আসার কোনও
উপায় নেই,’বলল কিলোলিয়ানা, ‘তার পাশে হামাগুড়ি
দিয়ে।’
‘ছাগলগুলোর পথ ধরে?’ জানতে চাইল কুলাউ।
‘ওগুলো এসেছে পাশের উপত্যকা
থেকে, কিন্তু এখানে আসতে পারবে না। কোনও পথও নেই। ওই লোকগুলো পাহাড়ি ছাগলের চেয়ে
চালাক নয়। হয়তো তারা নিজেদের মৃত্যু ডেকে আনবে। দেখা যাক।’
‘তারা সাহসী লোক,’ বলল কুলাউ। ‘দেখা যাক।’
অত্যন্ত পরিশ্রম করে উঠে আসতে লাগল তারা ওপরে,
ওপরে, আরও ওপরে, তারপর হঠাৎ করেই ঘটল ঘটনা। পা হড়কে গেল তিনজনের, গড়াতে গড়াতে একটা
শৈলশিরার প্রান্তে ধাক্কা খেয়ে, সোজা নেমে গেল তারা একহাজার ফুট নীচে।
খিকখিক করে হাসল কিলোলিয়ানা। ‘আমাদের আর ঝামেলা পোহাতে
হবে না,’ বলল সে।
‘তাদের সঙ্গে কামান আছে,’ জবাব দিল কুলাউ। ‘সেনারা এখনও লড়াইয়ে
যোগ দেয়নি।’
ঝিম ধরানো বিকেলে বেশিরভাগ কুষ্ঠরোগীই গভীর ঘুমে
আচ্ছন্ন হয়ে রইল নিজ নিজ গুহায়। রাইফেলটা পরিষ্কার করে, হাঁটুর ওপর রেখে, আপন গুহার
সামনে বসে দুলতে লাগল কুলাউ। এক ঝোপে শুয়ে বাহু-বেঁকে-যাওয়া কুমারীটা তীক্ষ্ণ চোখ
রাখল ক্ষুরধার পথটার ওপর। হঠাৎ চমকে জেগে গেল কুলাউ সৈকতের ওপর থেকে ভেসে আসা বিস্ফোরণের
শব্দে। আতঙ্ক-জাগানো সেই শব্দে যেন একদম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল চারপাশের শান্ত পরিবেশ।
ক্রমেই নিকটবর্তী হলো ভয়ঙ্কর শব্দ। শঙ্কিত চোখে, যেন বস্তুটাকে দেখার আশায়, ওপরদিকে
তাকাল কুলাউ। অনেক ওপরের খাড়া এক পাহাড়ে বিস্ফোরিত হলো গোলাটা, পাক দিয়ে দিয়ে বেরোতে
লাগল কালো ধোঁয়ার মেঘ। পাথর টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ল নীচে।
হাত দিয়ে জ্বর ঘাম মুছল কুলাউ। ভীষণ ভয় পেয়েছে
সে। গোলা সম্বন্ধে তার কোনও অভিজ্ঞতা নেই, আর বস্তুটা তার এ যাবৎ ধারণার চেয়ে অনেক
বেশি ভয়ঙ্কর।
‘এক,’ বলল কাপাহেই, যেন হঠাৎ
তার ওপর এসে পড়েছে। গোলা গোনার ভার।।
দ্বিতীয় আর তৃতীয় গোলা ছুটে গেল মাথার অনেক
ওপর দিয়ে, বিস্ফোরিত হলো দৃষ্টির আড়ালে কোথাও। যান্ত্রিকভাবে গুনে চলল কাপাহেই। কুষ্ঠরোগীরা
এসে জড়ো হলো গুহার সামনের ফাঁকা জায়গায়। প্রথমটায় তারা আতঙ্কিত হলো, কিন্তু একের
পর এক গোলা মাথার অনেক ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়ায় আশ্বস্ত হয়ে মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল
দৃশ্যটা। একেকটা গোলা বাতাস চিরে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উল্লসিত চিৎকার ছাড়ল বানরাকৃতির
দুই কুষ্ঠরোগী। আবার সাহস ফিরে এল কুলাউ-এর বুকে। কোনও ক্ষতি হয়নি কারও। পরিষ্কার
বোঝা যাচ্ছে, অতদূর থেকে অত বড় গোলা দিয়ে তারা রাইফেলের মত নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ
করতে পারবে না।
কিন্তু শিগগিরই পাল্টে গেল পরিস্থিতি। গোলাগুলো
আর ওপর দিয়ে ছুটে না গিয়ে এসে পড়তে লাগল কাছে। একটা বিস্ফোরিত হলো ক্ষুরধার পথটার
নীচের এক ঝোপে কুলাউ এর মনে পড়ল ওখানে পাহারায় থাকা কুমারীটার কথা, তাই ছুটল ঝোপ
অভিমুখে। হামাগুড়ি দিয়ে সে যখন ভেতরে ঢুকল, তখনও সেখান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সামনের
দৃশ্যটা তাকে স্তম্ভিত করে দিল। মেয়েটা যেখানে শুয়ে ছিল সেখানে এখন বিরাট এক গর্ত।
ঝোপের ডালগুলোর মতই টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সে। গোলাটা বিস্ফোরিত হয়েছে ঠিক তার ওপর।
একটা নজর বুলিয়ে কুলাউ শুধু নিশ্চিত হয়ে নিল
যে সেনারা ওই সরু পথ ধরে এগোবার চেষ্টা করছে না, তারপরেই সে ফিরতে লাগল গুহার দিকে।
গোঙানির শব্দ তুলে ছুটে যেতে লাগল গোলার পর গোলা, বিস্ফোরণে যেন কাঁপতে লাগল পুরো উপত্যকা।
গুহা চোখে পড়তে কুলাউ দেখল, আঙুলবিহীন হাতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তিড়িংবিড়িং করে
লাফাচ্ছে। বানরাকৃতির দুই কুষ্ঠরোগী। এবার কুলাউ কালো ধোঁয়ার মেঘ উড়ে উঠতে দেখল তাদের
দুজনের কাছ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তারা। একজন পড়ে রইল নিশ্চল হয়ে,
অন্যজন হাতের ওপর ভর দিয়ে দেহটাকে কোনওমতে টেনে নিয়ে চলল গুহার দিকে। তার পা দুটো
অসহায়ভাবে নেতিয়ে আছে মাটির ওপর, সারা শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটেছে রক্ত। সে যেন
গোসল করেছে রক্তে, এগোতে এগোতে কুঁইকুঁই করছে। ছোট্ট একটা কুকুরের মত। কাপাহেই ছাড়া
সব কুষ্ঠরোগী পালিয়ে গেছে গুহার আশ্রয়ে।
‘সতেরো,’ বলল কাপাহেই। আঠারো,’ গুনল সে আবার।
শেষ গোলাটা সোজা ঢুকে পড়ল একটা গুহায়। এই বিস্ফোরণে
সবাই আবার গুহা শূন্য করে বেরিয়ে এল বাইরে। কিন্তু ওই গুহা থেকে বেরোল না আর কেউই।
কটুগন্ধী ধোয়ার ভেতর দিয়ে হামাগুড়ি মেরে এগোল কুলাউ। চারটে শরীর ছড়িয়ে আছে ছিন্নভিন্ন
হয়ে। তাদের একজন দৃষ্টিহীন সেই মহিলা, শূন্য কোটর বেয়ে এখনও তার গড়িয়ে নামছে অশ্রু।
বাইরে আসতে কুলাউ দেখল, তার আতঙ্কিত প্রজারা
বুনো ছাগলের পথ ধরে ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে গিরিসঙ্কট বেয়ে যা তাদের নিয়ে যাবে
ওপাশের জড়ানো পর্বতশ্রেণীতে। হাতে ভর দিয়ে তাদের অনুসরণের ব্যর্থ চেষ্টা করছে বানরাকৃতির
কুষ্ঠরোগীটা।
‘ওকে মেরে ফেলাই ভাল,’ বলল কুলাউ, একই জায়গায়
বসে থাকা কাপাহেইকে।
‘বাইশ,’ জবাব দিল কাপাহেই।
‘হ্যা, ওকে মেরে ফেলাই
বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তেইশ-চব্বিশ।’
রাইফেলের লক্ষ্য তার দিকে স্থির হতে দেখে কুষ্ঠরোগীটার
গলা দিয়ে বেরিয়ে এল কুকুরের আর্তনাদ। ইতস্তত করল কুলাউ, তারপর নামিয়ে নিল রাইফেল।
‘কাজটা করা কঠিন,’ বলল সে।
‘তুমি একটা বোকা, ছাব্বিশ,
সাতাশ,’ বলল কাপাহেই। ‘মোটেই কঠিন কাজ নয়।
দাঁড়াও, আমি করে দেখাচ্ছি।’
পাথরের বিরাট একটা খণ্ড নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে,
এগোতে লাগল মারাত্মকভাবে আহত রোগীটার দিকে। আঘাত করার জন্যে যখন হাত তুলল সে ওপরে,
একটা গোলা এসে বিস্ফোরিত হলো তার শরীরে; রেহাই পেল সে কাজটা করার হাত থেকে, একইসঙ্গে
গোলাগোনার প্রয়োজনও ফুরাল তার।
গিরিসঙ্কটে কুলাউ এখন সম্পূর্ণ একা। তাকিয়ে
তাকিয়ে তার শেষ প্রজাটিকেও অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল ওপারে। তারপর ঘুরে সে নেমে এল সেই
ঝোপে যেখানে মারা গেছে কুমারীটা। এখনও বর্ষিত হচ্ছে গোলা, কিন্তু সে জায়গা ছেড়ে নড়ল
না; তার চোখ পড়েছে অনেক নীচের সেনাদের ওপর, এবার উঠতে শুরু করেছে তারা পাহাড় বেয়ে।
একটা গোলা বিস্ফোরিত হলো বিশ ফুট দূরে। একদম মাটির সমান্তরালে শুয়ে পড়ে সে অনুভব
করল তার শরীরের ওপর ঝুরঝুর করে ঝরে পড়া পাথরের কণা। হাও ফুলের রাশি রাশি হলুদ পাপড়িও
ঝরে পড়ল তার ওপর। মাথা সামান্য তুলে নীচের দিকে উঁকি মেরে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। রাইফেলের
বুলেট হলে সে একেবারেই ঘাবড়াত না, কিন্তু এই গোলা একটা জঘন্য জিনিস। প্রত্যেকবার গোলার
শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠে মাথা নামাল সে; তবে প্রত্যেকবারই মাথা তুলল সেনাদের
গতিবিধি দেখতে।
অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল গোলাবর্ষণ। এর কারণ হিসেবে
তার মনে হলো, সেনারা নিশ্চয় অনেক কাছে এসে পড়েছে। গিরিপথ ধরে আসছে তারা লম্বা একটা
সারিতে, গুনতে গুনতে একসময় সে আর গুনতে পারল না। অন্তত একশ’জন সেনা হবে-সবাই আসছে
শুধু কুষ্ঠরোগী কুলাউকে ধরতে। বুকের গভীরে ঝিকিয়ে উঠল তার ক্ষণস্থায়ী এক গর্ব। কামান
আর রাইফেল, পুলিশ আর সেনাসহ তারা এসেছে তাকে ধরতে-বিকৃত শরীরের একজন মাত্র মানুষ। তার
জন্যে ঘোষণা করেছে তারা একহাজার ডলারের পুরস্কার, জীবিত বা মৃত। সারাজীবনে সে একবারে
দেখেনি অতগুলো টাকা। ভাবনাটা তেতো করে ফেলল তার মন। কাপাহেই ঠিকই বলেছে। সে, কুলাউ,
কোনও অপরাধ করেনি। চুরি করা দেশে কাজ করানোর খাতিরে বিদেশি হারামজাদারা এনেছে চীনা
কুলি, আর সেই কুলিদের সঙ্গে এই দেশে এসেছে বিশ্রী রোগটা। আর এখন, যেহেতু তাকে এই রোগে
ধরেছে, তার মূল্য এখন একহাজার ডলার-কিন্তু সে-মূল্য তার জীবনের জন্যে নয়, গোলায় টুকরো
টুকরো হয়ে যাওয়া তার রোগে পচা জান্তব মৃতদেহটার জন্যে।
সেনারা যখন এসে পৌছুল অত্যন্ত সরু ক্ষুরধার পথটার
কাছে, সে তাদের সতর্ক করে দিতে চাইল। কিন্তু তার চোখ মৃত কুমারীটার ওপর গিয়ে পড়ায়
চুপ করে রইল সে। ছ’জন সেনা ক্ষুরধার পথটার ওপর উঠে পড়তে গুলি শুরু
করল কুলাউ। ক্ষুরধার পথটা সেনাশূন্য হয়ে যাওয়ার পরেও সে থামল না। বার বার খালি করে
ফেলল সে রাইফেলের ম্যাগাজিন, নতুন করে বুলেট ভরল, খালি করে ফেলল আবার মগজে তার আগুন
জ্বালল সারাজীবনের সহা অন্যায়, ফলে প্রতিহিংসা ডানা মেলল দাউদাউ করে। বুনো ছাগল যাতায়াতের
পুরো পথ জুড়ে গুলি চালাচ্ছে সেনারা, আশ্রয় নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে।
তার চারপাশে শিস কাটল বুলেট, ভোঁতা শব্দ তুলল, মাঝেসাঝে কোথাও ধাক্কা খেয়ে বাতাস চিরে
উল্টোদিকে ছুটল বোঁ বোঁ করে। একটা বুলেট চলে গেল তার খুলির চামড়া কেটে, দ্বিতীয় আরেকটা
শোল্ডার-ব্লেড ভেদ করল কোনও হাড় না ভেঙে এটা একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, তবে হত্যাকাণ্ডটা
চালাল একজন মাত্র মানুষ। পিছু হটতে লাগল সেনারা, দলের আহতদের সহায়তা করতে করতে।
তাদের ওপর গুলি চালাতে চালাতে কুলাউ সচেতন হয়ে
উঠল পোড়া মাংসের গন্ধে।
প্রথমটায় তাকাল সে চারপাশে, তারপর আবিষ্কার
করল যে গন্ধটা আসছে তার নিজেরই হাত থেকে। মাংস পুড়ছে রাইফেলের গরমে। তার হাতের বেশিরভাগ
স্নায়ু নষ্ট হয়ে গেছে কুষ্ঠরোগে। তাই, যদিও তার মাংস পুড়ছে আর নাকে আসছে জঘন্য গন্ধ,
অসাড় হাতে যন্ত্রণার লেশমাত্র বোধ নেই।
হাসিমুখে শুয়ে রইল সে ঝোপের মাঝে, যতক্ষণ না
মনে পড়ল কামানগুলোর কথা। নিশ্চয় আবার কামান চালাবে তারা, এবং এবার সেই ঝোপ লক্ষ্য
করে যেখান থেকে সে তাদের এতটা ক্ষতি করেছে। পাথুরে দেয়ালের গায়ে এমন একটা খাঁজ যেখানে
একটা গোলাও আঘাত হানেনি, স্থান পরিবর্তন করে কুলাউ সেখানে যাওয়ামাত্র আবার শুরু হলো
গোলাবর্ষণ। গুনতে লাগল সে। গিরিসঙ্কটে আরও ষাটটা গোলা এসে পড়ার পর বন্ধ হলো কামান
গুলো। বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণে ছোট জায়গাটার এমন অবস্থা হলো যেন সেখানে কোনও প্রাণীর
পক্ষেই বাঁচা সম্ভব নয়। এমনটাই ভাবল সেনারা, তাই বিকেলের কড়া রোদে আবার উঠতে লাগল
গিরিপথ বেয়ে। আবার পৌছুল তারা ক্ষুরধার পথের ওপর, আর কুলাউ-এর গুলির তোড়ে পিছু হটে
আবার নেমে গেল সৈকতে।
আরও দু’দিন কুলাউ রক্ষা করল
ক্ষুরধার পথটা, সেনারা গোলা ছুঁড়েই তৃপ্ত রইল। তারপর কুষ্ঠরোগী এক ছেলে, পাহাউ, গিরিসঙ্কটের
পেছনের এক পাথুরে দেয়ালের ওপর উঠে চিৎকার দিয়ে জানাল, তাদের সবার খাবার জন্যে বুনো
ছাগল শিকার করতে গিয়ে পাহাড় থেকে খাদে পড়ে মারা গেছে কিলোলিয়ানা, আর তাই আতঙ্কিত
মহিলারা বুঝতে পারছে না এখন কী করা উচিত। ছেলেটাকে কাছে ডেকে, তার হাতে একটা রাইফেল
দিয়ে গিরিপথ পাহারা দিতে বলল কুলাউ। সে দেখল, তার প্রজারা হতাশ হয়ে পড়েছে। তাদের
বেশিরভাগ এত অসহায় যে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে নিজের খাবারটুকু পর্যন্ত সংগ্রহ করে
খেতে পারে না, ফলে তারা সবাই অনাহারে আছে। শরীরে রোগ এখনও জেঁকে বসেনি এমন দু’জন মহিলাকে সে গিরিসঙ্কটে
পাঠাল খাবার আর মাদুর আনতে। বাকিদের সে জোগাল সাহস আর সান্ত্বনা, শেষমেশ সবচেয়ে দুর্বল
মহিলাটিও হাত লাগাল আশ্রয় তৈরির কাজে।
কিন্তু যাদের খাবার আনতে পাঠাল, তারা আর না ফিরতে,
পিছাতে লাগল কুলাউ গিরিসঙ্কট অভিমুখে। পাথুরে দেয়ালটার কেবল প্রান্তে এসেছে সে, গর্জে
উঠল আধ ডজন রাইফেল। একটা বুলেট ফুটো করে দিল তার কাঁধের মাংস, দ্বিতীয় বুলেটের ঘায়ে
ছিটকে আসা পাথরের টুকরোয় কেটে গেল গাল। একলাফে দেয়ালের নিরাপত্তায় সরে আসার মুহূর্তে
সে দেখল, গিরিসঙ্কটটা প্রায় ভরে গেছে সেনাতে। তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তারই
প্রজারা। গোলাবর্ষণের ভয়ঙ্করত্বের মুখোমুখি হবার চেয়ে তারা বরং চলে যেতে চায় মোলোকাই
কারাগারে।
বুলেটের সবচেয়ে ভারী বেল্টগুলোর একটা খুলে ফেলল
কুলাউ। নিশ্চল শুয়ে রইল পাথরের মাঝে, তারপর প্রথম সেনাটার মাথা আর কাঁধ পরিষ্কারস্ফুটে
উঠতে, টেনে দিল ট্রিগার। দু’বার এরকম ঘটনা ঘটার পর, খানিক বিরতিতে,
মাথা আর কাঁধের পরিবর্তে পাথুরে দেয়ালের পেছন থেকে ভেসে উঠল একটা সাদা পতাকা।।
‘তুমি কী চাও?’ জানতে চাইল সে।
‘আমি তোমাকে চাই, অবশ্য
তুমি যদি কুষ্ঠরোগী কুলাউ হও,’ জবাব এল।
কুলাউ ভুলে গেল তার অবস্থান, ভুলল সবকিছু, শুয়ে
শুয়ে অবাক হয়ে সে ভাবতে লাগল এই বিদেশিগুলোর আজব জেদের কথা, আকাশ মাথার ওপর ভেঙে
পড়লেও তারা সম্ভবত নিজেদের জেদ বজায় রাখবে। হ্যা, মানুষ
বা আর সবকিছুর ওপর তারা তাদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে চায়, এমনকী আপন মৃত্যুর বিনিময়েও।
জীবনকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার সেই ইচ্ছেশক্তির প্রশংসা সে না করে পারল না। এতই
শক্তিধর সেই ইচ্ছে যা সবকিছুকে তাদের ইচ্ছের পথে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য করে। অসম এই লড়াইয়ে
যে কোনও আশা নেই তা-ও সে অস্বীকার করতে পারল না। একহাজার বিদেশিকেও যদি হত্যা করে সে,
তবু তারা মাথাচাড়া দেবে সাগর সৈকতের বালিরাশির মত। তারা জানে না তাদের পরাজয়। এটাই
তাদের দোষ আর এটাই তাদের গুণ। তার আপন মানুষজনের মাঝে রয়েছে এই বস্তুটিরই অভাব। এখন
সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে, কীভাবে তাদের দেশ দখল করেছে মুষ্টিমেয় ধর্মপ্রচারক আর ব্যবসায়ী।
কারণ---
‘তুমি কী বলতে চাও? আসবে
আমার সঙ্গে?’
সে কথাটা বলছে সাদা পতাকা তুলে ধরা অদৃশ্য মানুষটা।
আর দশজন বিদেশিদের মতই একজন, যে এগিয়ে এসেছে মৃত্যুর ছায়া দেখেও।।
‘এসো, আমরা আলাপ করি,’ বলল কুলাউ। প্রথমে
জেগে উঠল সেনাটার মাথা আর কাঁধ, তারপর পুরো শরীর। মসৃণ মুখের, নীলচোখো, বছর পঁচিশের
এক যুবক, ছিপছিপে শরীরে চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে ক্যাপটেনের ফিটফাট পোশাকে। এগোতে এগোতে,
থেমে, বসল সে গজ বারো দূরে:
‘তুমি সাহসী মানুষ,’ বলল কুলাউ অবাক স্বরে।
‘এখন ইচ্ছে হলে আমি তোমাকে
স্রেফ একটা মাছির মত খতম করে ফেলতে পারি।’
‘না, সেই ইচ্ছে তোমার
হবে না,’ জবাব দিল যুবক।
‘কেন?’
‘কারণ, রোগে শরীর যতই
বিকৃত হোক, তুমি একজন খাঁটি পুরুষ, কুলাউ। আমি তোমার অনেক গল্প জানি। কাপুরুষের মত
হত্যা করা তোমার পছন্দ নয়।’
ঘোত করে উঠল কুলাউ, তবে সুখের ছোঁয়া অনুভব করল
মনের গহীনে।
‘আমার লোকজনদের নিয়ে
তুমি কী করেছ? জানতে চাইল সে। ছেলেটা, দুই মহিলা, আর মানুষটা?’
‘তারা আত্মসমর্পণ করেছে,
আমি এসেছি তোমাকেও আত্মসমর্পণ করাতে।’
হাসল কুলাউ অবিশ্বাস ভরে।
‘আমি একজন স্বাধীন মানুষ,’ ঘোষণা করল সে। ‘কোনও অপরাধ করিনি। আমাকে
তোমরা একা থাকতে দাও, এটুকুই কেবল আমার দাবি। আমি স্বাধীনভাবে জন্ম নিয়েছি, স্বাধীনভাবে
বসবাস করেছি, মরবও আমি স্বাধীনভাবেই। কখনওই আত্মসমর্পণ করব না।’
‘তা হলে তোমার লোকেরা
তোমার চেয়ে জ্ঞানী,’ জবাব দিল যুবক ক্যাপটেন। ‘ওই দেখো-ওরা আসছে
ঘুরে কুলাউ দেখল তার দলের অবশিষ্টদের মিছিল।
গোঙাতে গোঙাতে এগিয়ে আসছে বীভৎস মানুষের এক সারি। এগোল তারা আরও, এগোল আর অপমানকর
মন্তব্য ছুঁড়ল কুলাউ-এর উদ্দেশে। সবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে এল কুৎসিত এক বুড়ি, থেমে
সামনে বাড়াল সে পাখির মত নখরঅলা একটা হাত, তারপর মূর্তিমান মৃত্যুস্বরূপ মাথাটা একপাশ
থেকে আরেক পাশে দোলাতে দোলাতে অভিশাপ দিল কুলাউকে। একের পর এক পেরিয়ে গেল তারা পাথুরে
দেয়ালের প্রান্ত, আর আত্মসমর্পণ করল আত্মগোপন করে থাকা সেনাদের কাছে।।
এবার তুমি যেতে পারো,’ বলল কুলাউ ক্যাপটেনকে।
‘আমি কখনওই আত্মসমর্পণ
করব না। এটাই আমার শেষ কথা। বিদায়।’
শৈলশিরা পেরিয়ে ক্যাপটেন ফিরে এল তার সেনাদের
কাছে। পরমুহূর্তে কোনও পতাকা না দেখিয়ে সে তুলে ধরল একটা হ্যাট, এবং চোখের পলকে সেটাকে
ফুটো করে দিল কুলাউ-এর বুলেট। সেই বিকেলে গোলাবর্ষণ করতে করতে তাড়িয়ে দেয়া হলো তাকে,
পিছিয়ে এসে আশ্রয় নিল সে আরোহণের প্রায় অসাধ্য পর্বতমালার খাঁজে। তবু তাকে অনুসরণ
করল সেনারা। ছয় সপ্তাহ ধরে খোজা হলো তাকে এক খাঁজ থেকে আরেক খাজে, আগ্নেয়গিরির চূড়ায়,
বুনো ছাগল যাতায়াতের পথে। যখন সে লুকাল ল্যান্টানার বনে, অনুসরণ করল বনতাড়ুয়ার দল,
ল্যান্টানা বন থেকে পেয়ারা ঝোপের মাঝে মাঝে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো হলো তাকে ঠিক একটা
খরগোশের মত। তবু সক্ষম হলো সে সবার চোখে ধুলো দিতে। সেনাদল কিছুতেই তাকে কোণঠাসা করতে
পারল না। কেউ খুব কাছে চলে এঁলে, তার অব্যর্থ রাইফেল তাকে পৌঁছে দিল মৃত্যুর জগতে।
ঝোপের মাঝে তার তামাটে শরীর পলকের জন্যে চোখে পড়ামাত্র গুলি চালাল সেনারা। একবার,
পাঁচ সেনা তাকে দেখে ফেলল বুনো ছাগল যাতায়াতের পথে! মুহূর্তে তারা খালি করে ফেলল নিজ
নিজ রাইফেল, তবু খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে গেল সে পর্বতের আরও উঁচু খাজে। মাটির ওপর রক্তের
চিহ্ন দেখে তারা বুঝল, কুলাউ আহত হয়েছে। ছয় সপ্তাহ পর হাল ছেড়ে দিল সেনাদল। পুলিশ
আর সেনাবাহিনী ফিরল হনলুলুতে, কালালাউ উপত্যকা বজায় রইল তার রাজ্য হিসেবে। অবশ্য একহাজার
ডলারের লোভে মাঝে মাঝে তার পিছু নিল মুণ্ডশিকারীরা, কিন্তু সেই লোভ তাদের উপহার দিল
মৃত্যু।
দু’বছর পর, শেষবারের মত
হামাগুড়ি দিয়ে কুলাউ গিয়ে ঢুকল এক ঝোপে, শুয়ে পড়ল টাই-পাতা আর বুনো আদাফুলের মাঝে।
স্বাধীনভাবে বসবাস করেছে সে, এবং মারাও যাচ্ছে স্বাধীনভাবেই। ঝুরঝুর করে পড়তে লাগল
বৃষ্টির ফোটা, জীর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢাকল সে জীর্ণ এক কম্বলে। শরীরে জড়ানো অয়েলস্কিনের
কোট, বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা মাউজার রাইফেল। পরম স্নেহে মুছল সে নলের ওপরের ময়লা,
কিন্তু যে হাত দিয়ে মুছল এমন একটা আঙুলও তাতে আর অবশিষ্ট নেই যা দিয়ে টানা যাবে রাইফেলের
ট্রিগার। বন্ধ করল সে চোখজোড়া, কারণ, ভীষণ শারীরিক দুর্বলতা আর মগজের ভেতরের অস্পষ্ট
এক আলোড়ন তাকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল, আর বেশি দূরে নেই শেষের সেই ক্ষণ। মরার সময় যেমন
আড়াল খোজে বুনো পশু, ঠিক তেমনই যেন সে আজ আড়াল খুঁজে নিয়েছে ঘন এই ঝোপে। অর্ধ-সচেতন,
লক্ষ্যহীন, ভবঘুরে, ফিরে গেছে সে আবার নিহাউ-এর শৈশবে। যতই অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে জীবন,
আর কানে অস্পৃষ্ট হয়ে আসছে বৃষ্টির রিমঝিম, ততই যেন ঝলকাচ্ছে শৈশবের দৃশ্যাবলী। আবার
যেন ব্যস্ত হয়ে ঘোড়া বশ মানাচ্ছে সে, ওদিকে প্রতিবাদে লাফাচ্ছে ঘোড়ার বাচ্চা গুলো
পরমুহূর্তেই, তেড়ে যাচ্ছে সে পার্বত্যাঞ্চলের তৃণভূমিতে চরা বুনো ষাঁড়ের দিকে, তারপর
রশির ফাঁস ছুঁড়ে বশ মানিয়ে সেগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে নীচের উপত্যকায়।
টগবগিয়ে ছুটে বেড়াল সে তারুণ্যের তেজী রাজ্যে,
অবশেষে নিদারুণ এক যন্ত্রণা তাকে ফিরিয়ে আনল বাস্তবে। বিকৃত হাতজোড় ওপরে তুলে তাকিয়ে
রইল সে অবাক হয়ে! কিন্তু কীভাবে? কেন? পূর্ণ সেই বুনো যৌবন কেন পরিবর্তিত হবে এই বীভৎসতায়?
তারপর, একমুহুর্তের জন্যে, আবার তার মনে পড়ল যে সে হলো কুলাউ, কুৎসিত এক কুষ্ঠরোগী।
ক্লান্তিতে কাপতে কাপতে বুজে গেল তার ভারী চোখের পাতা, কান আর শুনতে পেল না বৃষ্টিপাতের
শব্দ! পুরো শরীরে শুরু হলো এক কাপুনি সেই কাপুনিও থামল একসময়। মাথাটা অর্ধেক তুলল
সে মাটি থেকে, কিন্তু সেটা আবার গড়িয়ে পড়ল পেছনে। তারপর খুলে গেল তার চোখজোড়া,
আর বন্ধ হলো না। চেতনার সর্বশেষ বিন্দুতে তার ঝলকিত হলো মাউজারের কথা, আর তাই বেঁকে
যাওয়া, আঙুলবিহীন হাতে রাইফেলটাকে সে বুকে চেপে ধরল গভীর মমতায়।
মূলঃ জ্যাক লণ্ডন
রূপান্তর: খসরু চৌধুরী
সম্পাদনাঃ মারুফ মাহমুদ
Tags: অনুবাদ গল্প, জীবনের গল্প, বিদেশি গল্প, রোমাঞ্চ গল্প, রোমাঞ্চ উপন্যাস, Koolau the Leper, Bangla translation, Jack London, জ্যাক লন্ডন, কুলাউ দ্যা লিপার
No comments:
Post a Comment